"পল্লীসমাজ" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’ তাঁর পারিবারিক উপন্যাসগুলাের মধ্যে অন্যতম। পল্লীসমাজের নীচতার একাধিক চিত্র আঁকা হয়েছে ‘পল্লীসমাজ' উপন্যাসে। এ সম্পর্কে বেণী ঘােষাল ও গােবিন্দ গাঙুলীর নাম আসে সবার আগে। পৃথিবীতে কোনাে দুষ্কর্মই তাদের বাকি নেই-চুরি, জুয়াচুরি, জাল, ঘরে আগুন দেওয়া, মিথ্যা কুৎসা রটনা করা, রমণীর সর্বনাশ করা ইত্যাদি। পল্লীসমাজ এসব পাপাচারীদের দুষ্কর্মে ভারাক্রান্ত। শরৎচন্দ্র এদের পাপের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা যেমন স্পষ্ট তেমনি তীব্র। কিন্তু তবু মনে হয় এই দুটি পুরুষের চিত্র সজীব হতে পারেনি সম্পূর্ণরূপে। এরা যেন অন্যায় কাজ করার কল মাত্র। যন্ত্রের মতাে গতিশীল, কিন্তু যন্ত্রের মতােই প্রাণহীন। কারণে অকারণেই শুধু পরের অমঙ্গল সাধনের জন্যই এদের সৃষ্টি-মনে দ্বিধা নেই, সুদৃঢ় কোনাে উদ্দেশ্য নেই, অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে মনে নতুন ভাবের ক্রিয়া-প্রক্রীয়া নেই, ব্যবহারেও বৈচিত্র নেই। ইয়াগাে চরিত্রে সেক্সপীয়র নিছক উদ্দেশ্যহীন পাপপ্রবৃত্তির চিত্র এঁকেছেন, কিন্তু ইয়াগাের মনেও উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন জেগেছে, শেষের দিকে একটু সঙ্কোচের ভাবও এসেছে। এই দুর্বলতা মানবােচিত, তা থাকলে সে হতাে কলের দানব। বেণী ঘােষাল, গােবিন্দ গাঙ্গুলীকে রক্তমাংসের অনুভূতিশীল। মানুষ বলে মনে হয় না। ‘পল্লীসমাজ' উপন্যাসে শরৎচন্দ্র প্রধানত জমিদারের শােষণ-নির্যাতন ও সামন্ত তান্ত্রিক মতাদর্শের সাথে শিক্ষিত বিজ্ঞানচেতনা-সমৃদ্ধ রমেশের সংঘর্ষের ইতিকথার চিত্র এঁকেছেন। এ উপন্যাসে গ্রাম-বাংলার বিচিত্র দুঃখ-কষ্টের কাহিনী, জমিদারের শশাষণ-নির্যাতনের বিবরণ, বালবিধবা রমার দুর্দশা, ভালােবাসার-বেদনার কাহিনী।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।