সুদূর হিমালয়ের একটেরে নাইনিতাল।। ঐ জায়গার মায়া আমাকে আজ তিরিশ বছর বেঁধে রেখেছে। কেমন করে নদীর স্রোতে-ভাসা খড়কুটোর মত এইখানে পাহাড়তলীতে আটকে গেলাম, তা ভাল করে বুঝে উঠতে পারিনি। অনেক দিন বাংলাদেশের কোন খোঁজ-খবর রাখিনি। খবরের কাগজের মরাফত যেটুকু ছাপ আসে সেইটুকু পর্যন্ত। ব্যাস? এর বেশি নয়। বর্ষাকালের এক সকালে হঠাৎ আমার বাসায় স্কুল-জীবনের এক বন্ধু এসে হাজির। পাঁচ-সাত বছর আগে পর্যন্ত সে আমাকে চিঠি লিখত। এখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তারপর আর কোন খবর রাখিনি, আজ তাকে সশরীরে দেখে আনন্দে উফুল্ল হয়ে উঠলুম। এমন অসময়ে? চুপ কর। ছুটি কাটাতে এসেছি। আজ সাত-সাতটা বছর একটা চিঠি পর্যন্ত লিখিসনি। একটু ঘাবড়ে গেলুম। -তুই কি লিখেছিলি? সেদিকে আমার দোষ নেই, বুঝলি। আমার চিঠির উত্তর না পেলে আমি উত্তর দেব কেন? আমার বন্ধুর নাম মােস্তাক। অভিমান তার সত্যি সঙ্গত। আমিই তাকে চিঠির উত্তর দিইনি। -কুলীর কাছ থেকে মালপত্র বুঝে নে। রাখ বাজে কথা। সারা রাত ট্রেনে ঘুম হয়নি, কিছু খাওয়া আর ঘুমােবার ব্যবস্থা কর। -সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। | খুব খুশি হলুম অনেক বছর পরে। আজ বাংলা বলতে পেয়ে। হিন্দী আর পাহাড়ী ভাষায় জাবর কেটে, রুটি আর গােশত খেয়ে আমার বাঙালি ছাঁটকাট কিছু নেই। হঠাৎ দেখে বােঝাও মুশকিল। | বিকেলে বন্ধুকে নিয়ে শিকারে বেরুলুম। ম্যাজিস্ট্রেট মানুষ। শিকারীর সাজ-পােষাক পরা, হাতে রাইফেল। পাহাড়তলীতে আমার সুনাম যে আরাে বেড়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। সবাই ভাববে আমার সাথে এমন সব লােকের আলাপ, যারা সাহেব। বন্ধুর সাথে হাঁটতে আমারও খুব ভাল লাগছিল। আজ কত বছর বাঙালি আদৃমী দেখিনি-উঃ। সেদিন কিন্তু শিকার পাওয়া গেল না একটা ছােট হরিণ ছাড়া। পাহাড়তলী ছেড়ে বনের ভেতর বেশি দূরে যাইনি। কারণ বর্ষাকালে বড় সাপের ভয়। প্রহর রাত্রির পর পাহাড়তীর এদিক-ওদিক ঘুরে বাড়ি ফিরলুম। আমার উঠানের সামনেই একটা চেনাবের গাছ ডালপালা ফেলে তলাটাকে ছায়াঘন করে রেখেছে। | সেখানে দুটো চেয়ারে দুই জন মুখােমুখি হয়ে বসলুম। অনেক গল্প হলাে। বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিল। আশ্বিনের ছুটিতে পােটলাপুটলি হাতে, গায়ে-ঢােকার পথে ভিজে বাশ পাতার মর্মর আর কটু গন্ধ, মায়ের হঠাৎ হেসে ওঠা ডাক, “ক’টার ট্রেনে এলি”-সব আজ মােস্তাককে দেখে মনে পড়তে লাগল । কত দরে বাংলাদেশ!
(Sowkot Osman) তাঁর পৈতৃক নাম শেখ আজিজুর রহমান। নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, রাজনৈতিক লেখা, শিশু-কিশোর সাহিত্য সর্বত্র তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তিনি ছিলেন এক উচ্চকিত কণ্ঠের অধিকারী। জন্ম -১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি পশ্চিম বঙ্গের হুগলী জেলার জেলার সবল সিংহপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।বাংলাদেশের একজন চিন্তক, লেখক ও কথাসাহিত্যিক। পিতা শেখ মোহাম্মদ এহিয়া, মাতা গুলজান বেগম। পড়াশোনা করেছেন মক্তব, মাদ্রাসা, কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা শুরু করলেও পরবর্তীকালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ও অর্থনীতি বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। কিন্তু একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। আইএ পাস করার পর তিনি কিছুদিন কলকাতা করপোরেশন এবং বাংলা সরকারের তথ্য বিভাগে চাকরি করেন। এমএ পাস করার পর ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে লেকচারার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ অফ কমার্সে যোগ দেন এবং ১৯৫৮ সাল থেকে ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্বেচ্ছা অবসরে যান। চাকরি জীবনের প্রথমদিকে কিছুকাল তিনি ‘কৃষক’ পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেন। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ শওকত ওসমানকে বলতেন 'অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ'। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর তিনি চলে আসেন পূর্ববঙ্গে।বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনে জীবনব্যাপী অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার - এই তিনটিতেই ভূষিত হয়েছিলেন। ক্রীতদাসের হাসি তাঁর একটি জনপ্রিয় ঐতিহাসিক উপন্যাস। তাঁর জনপ্রিয় গ্রন্থ গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ জননী, জাহান্নম হইতে বিদায়, বনী আদম, ওটেন সাহেবের বাংলো, কালরাত্রি খ-চিত্র, মুজিবনগর, দুই সৈনিক ও অন্যান্য। মৃত্যু -১৪ মে ১৯৯৮।