বাংলা ছড়াকে প্রথম মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। আজ থেকে একশ বারো বছর আগে বাংলা ১৩০৬ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমনির ছড়া’ বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে তিনিই প্রথম ‘ছড়াসাহিত্য’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ছড়াকে ছড়াসাহিত্যের মর্যাদায় সমুন্নত রাখতে ছড়াকারদের চেষ্টার কমতি নেই। কখনো প্রবীনদের প্রদর্শিত পথে হেঁটে, কখনো প্রবীণদের প্রদর্শিত পথকে অস্বীকার করে নবীন ছড়াকাররা ছড়াকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অতীতে ছড়া রচিত হতো মুখে মুখে। গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন সহজ সরল মানুষেরা মুখে মুখে বানাতেন ছড়া। গাঁয়ের বধূরা তাঁদের শিশুসন্তানকে মমতা আর আদরে সিক্ত করতে খেলাচ্ছলে ছড়া বানাতেন মুখে মুখে। কেউ সেটা লিখে রাখত না বা লিখে রাখার সুযোগ তখন ছিল না। মা-খালাদের মুখ থেকে শুনে শুনে অন্যেরা সেটা আওড়াতে চাইতেন। এরকম আওড়াতে গিয়ে শ্র“তি নির্ভর স্মৃতিতে ধরে রাখা ছড়াটির কোনো কোনো শব্দ বা অংশ যেতো পালটে। ভুলে যাওয়া শব্দটির জায়গায় অবলীলায় নতুন শব্দ বসিয়ে নিতেন তাঁরা অপরূপ দক্ষতায়। গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষদের এই দক্ষতাকে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন অশিক্ষিতের পটুত্ব। লোক মুখে সেই ছড়া ছড়িয়ে পড়ত। আর ছড়িয়ে পড়ার ধারাবাহিক পরিক্রমায় মূল ছড়াটির আদল কিছুটা বদলে যেতো। সে কারণেই প্রাচীন একটি ছড়ার বেশ কয়েকটি রূপ আমরা দেখতে পাই। অশিক্ষিতের পটুত্বের নিদর্শন সেই ছড়াগুলোর রচয়িতার নামটি আমরা আর খুঁজে পাই না। ছড়াটি টিকে থাকে লোকমুখে লোকসমাজে কিন্তু ছড়াকার যান হারিয়ে। ক্রমে ক্রমে লিখতে জানা মানুষেরা গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে থাকা সেই মনিমানিক্যগুলো অর্থাৎ ছড়াগুলো তুলে এনেছেন লেখ্য রূপে। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমনির ছড়া’ সেই রকম একটি রতœভাণ্ডার। এরপর দিন গড়িয়েছে। মানুষ আরো আধুনিক হয়েছে। আধুনিক শিক্ষিত মানুষজন ছড়া রচনায় আগ্রহী হয়েছেন। ছড়ার সেই দীর্ঘ পথপরিক্রমার ধারাবাহিক অভিযাত্রায় শামিল হয়েছেন তরুণরাও। ছড়াকে ভালোবেসে ছড়াকেই আরাধ্য করেছেন অনেক মেধাবী তরুণ। সেই তরুণদের মেধার দীপ্তিতে আলোকিত হয়েছে ছড়ার ভুবন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছড়ার ধারায় প্রতিশ্র“তির ঝিলিক দেয়া তরুণদের তালিকায় একটি উজ্জ্বল নাম বশির আহমদ জুয়েল। তাঁর রচিত ছড়ার সংখ্যাও কম নয়। সমাজ সচেতন এবং রাজনীতি সচেতন ছড়াকার হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি পাঠকের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। পত্র-পত্রিকা এবং অন্তর্জালে তাঁর ছড়া নিয়মিতই প্রকাশিত হয়। জুয়েলের ছড়ার একজন অনুরাগী পাঠক হিসেবে আমি লক্ষ্য করেছি যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার বিষয়ে তিনি আপোসহীন। একজন দেশপ্রেমিক ছড়াকার বশির আহমদ জুয়েল তার চিন্তায় চেতনায় মননে ও মেধায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করেন গভীর নিষ্ঠা আর একাগ্রতায়। জুয়েলের ছড়ার এই বইটি অর্থাৎ শত ছড়ায় মুক্তিযুদ্ধ-ই প্রমাণ করে বাঙালির সবচে’ বড় অর্জন এবং সংগ্রামকে তিনি কতোটা আবেগ দিয়ে ধারণ করেন তাঁর মস্তিষ্ক ও হৃদয়ে। জুয়েলের মতো সচেতন ছড়াকাররা স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে রুখে দিতে দিবারাত্রি কড়া নাড়েন আমাদের দরোজায়। ঘুমিয়ে পড়া জাতির আড়ষ্টতা আর নিস্পৃহতা কাটাতে শত ছড়ায় মুক্তিযুদ্ধ বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস। তরুণ ছড়াবন্ধু বশির আহমদ জুয়েলের জন্যে নিরন্তর শুভকামনা। [শত ছড়ায় মুক্তিযুদ্ধ, বশির আহমদ জুয়েল, প্রকাশক- প্রতিভা প্রকাশ, প্রচ্ছদ- ইয়াহইয়া ফজল, মূল্য-১৫০ টাকা, প্রকাশকাল- একুশে বইমেলা-২০১২ ]
বশির আহমদ জুয়েল। পিতা মাে. আব্দুল হান্নান ও মাতা রঙ্গের বেগম। পাঁচ ভাই ও এক বােনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার শিবরামপুর মনতলা গ্রামে তাঁর জন্ম । শক্তিমান ছড়াকার ও ছড়ার ছােট কাগজ ছন্দালাপ সম্পাদকের জীবনধারা অত্যন্ত অর্থবহভাবে মােড় নেয় ২০০৮ এর একুশে বইমেলায় তার ভালােবাসার চাদর' নামের ছড়াগ্রন্থের মাধ্যমে। ভালােবাসার ছড়ার এই গ্রন্থটি বাজারে আসার সাথে-সাথে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। তরুণ পাঠকদের কাছে প্রিয় ছড়াকার হয়ে ওঠেন বশির আহমদ জুয়েল । গ্রন্থটি পরপর ছয়টি সংস্করণে প্রকাশ করতে বাধ্য হন প্রকাশক। রাজধানীর বাইরে থেকেও বই লিখে এবং প্রকাশ করে ব্যবসা করতে পারার দৃষ্টান্ত এই শক্তিমান ছড়াকার। তরুণ এই লেখকের এক সাথে দু’টি উপন্যাস রাজাকারের মেয়ে ও চাদনী রাতে বৃষ্টি প্রকাশ হয়েছে। ২০০৯ সালের বইমেলায়। উপন্যাস দু’টির সফলতায় কথাশিল্পীর পরিচিতি এনে দিয়েছে তাঁকে। ছড়ার পাশাপাশি সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও রয়েছে তাঁর সমান বিচরণ। ইদানিং আমি ও আমার কবিতা নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থও বের হয়েছে। এ ছাড়াও ভালােবাসার আডডা, ভালােবাসার ছড়া, কোটি টাকার ছড়া ও উষা আমার ময়না পাখি নামের ছড়াগ্রন্থগুলােও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। বশির আহমদ জুয়েল একজন প্রতিভাবান লেখক হিসেবে নিজের শক্তিমত্তার বিকাশ ঘটাচ্ছেন সৃজনশীল লেখনির মাধ্যমে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার বের হলাে তার ভালােবাসার ১০০ ছড়া নামের ছড়াগ্রন্থ। তরুণ ছড়াকার হিসেবে বশির আহমদ জুয়েলের এ গ্রন্থটি ব্যাপক সাড়া ফেলবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ ছাড়াও এবারের বইমেলায় জুয়েলের শত ছড়ায় মুক্তিযুদ্ধ নামে আরাে একটি বই বের হয়েছে। -প্রকাশক