"ওজারতির দুই বছর"বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: আতাউর রহমান খান (১৯০৭-৯১) এ দেশের সর্বাগ্রগণ্য রাজনীতিকদের একজন। পেশায় ছিলেন আইনজ্ঞ কিন্তু রক্তে ছিল রাজনীতির নেশা। তাঁর সময়ের অনেকের মতাে তিনিও মনে করতেন, রাজনীতির মধ্য দিয়েই সর্বোত্তমভাবে দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষা ও কল্যাণ সাধন করা যায়। আর এই বােধ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা নিয়েও তিনি যােগ দিয়েছিলেন রাজনীতিতে। স্বাধীন জীবিকার উপায় হিসেবে বেছে নেন আইনজীবীর পেশা। ১৯৪৭-পূর্ব সময়ে মুসলিম লীগে যােগ দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হন। কিন্তু উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হিসেবে ভারত ভাগ ও পাকিস্তানের দাবিকে সমর্থন করলেও তিনি ও তাঁর সতীর্থদের অনেকে পাকিস্তানকে দেখতে চেয়েছিলেন একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। বলাই বাহুল্য, তাদের সে স্বপ্ন শুরুতেই একটা বড় ধরনের হোঁচট খায় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকদের আচরণে। এরই পাশাপাশি আরও নানা ঘটনায় দল হিসেবে মুসলিম লীগ ও রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের চরিত্র উন্মােচিত হতে থাকে। এ অবস্থায় ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে মাওলানা ভাসানী ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে। আতাউর রহমান খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালেও প্রথমে আওয়ামী লীগের ও পরে এনডিএফের নেতা হিসেবে ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি বিশিষ্ট অবদান রাখেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর প্রথমে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য ও পরে ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। সেই সুবাদে প্রশাসনের ভেতর থেকেও পাকিস্তানি শাসক ও শােষকদের ভয়ংকর চেহারা ও চরিত্র নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযােগ হয় তাঁর। মূলত এসব অভিজ্ঞতাই ওজারতির দুই বছর বইয়ের বিষয়। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ তথা ঔপনিবেশিক আচরণ এবং আমলাতন্ত্রের গণবিরােধী চরিত্রটি তিনি নানা দৃষ্টান্তসহযােগে তুলে ধরেছেন। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসনে নিয়ােগের ক্ষেত্রেও বাঙালিদের প্রতি চরম বৈষম্য প্রদর্শনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এ বইতে। এর প্রেক্ষাপটেই উঠে এসেছে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তনের প্রসঙ্গ। আছে যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, শরিকি দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমতার লােভে রাজনীতিকদের অনেকের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কথাও। বস্তুত রাজনীতিকদের এই দ্বন্দ্ব ও দুর্বলতার সুযােগেই ঘটে সামরিক শাসন জারি ও আইয়ুব খানের ক্ষমতা গ্রহণ। আর এ সবকিছুর পেছনেই ছিল পাকিস্তানি শাসকদের সূক্ষ্ম ও গভীর ষড়যন্ত্র । সরস ভাষায় ও সরল ভঙ্গিতে লেখা আতাউর রহমান খানের এ বই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্বকালের একটি রাজনৈতিক কালপর্বের মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল।