ইসলাম ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বইটি ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত একটি সেমিনারে ড. এম উমর চাপরার উপস্থাপিত প্রবন্ধের বর্ধিত সংস্করণ। বিগত শতাব্দীতে যদিও বিশ্বে পুঁজিবাদী এবং সমাজবাদী দু'টো অৰ্থব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, বর্তমানে কেবল পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাই গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিকল্প হিসেবে ইসলামী অর্থব্যবস্থাই একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সামগ্রিক অর্থ ব্যবস্থার রূপ নিচ্ছে- যা পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদেরও নাড়া দিচ্ছে । এ ব্যবস্থার শক্তির ভিত্তি কোন মানুষের তৈরি মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং ঐশী গ্রন্থ আল কুরআনই এর মূল ভিত্তি। ড. এম. উমর চাপরা এ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। এ অর্থনীতির প্রয়োগের জন্য একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রকে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী বা প্রাচ্যের সমাজবাদী অর্থব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে থাকার দরকার হবে না ৷ মুসলিম বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ইসলামী অর্থনীতি পড়ানো হয়। সুতরাং ইসলামী সামগ্রিক দৃষ্টিকোণের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেহেতু সকল মুসলিম দেশ উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্গত, সেহেতু উন্নয়ন অর্থনীতির উপর একটি টেকস্ট বইয়ের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরে অনুভূত হয়ে আসছিল। যদিও এ বিষয়ের উপর কিছু বই আজকাল পাওয়া যায়, তথাপি এমন একটি টেক্সট বইয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যে বইতে উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিউক্লাসিক্যাল এবং সমাজতান্ত্রিক কৌশলসমূহের মূল্যায়ন করা হয়েছে এটা দেখানোর জন্য যে, কেন এ সমস্ত কৌশল মুসলিম দেশসমূহকে তাদের উন্নয়ন অর্জনে সফলতার মুখ দেখাতে পারেনি বা ব্যর্থ হয়েছে। ইসলামিক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে এমন একটি উন্নয়ন কৌশল বিনির্মাণে মুসলিম দেশগুলিকে সাহায্য করতে হলে ওরকম একটি টেক্সট বইয়ের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। এরূপ একটি প্রয়োজন পূরণার্থে বইটি রচনা করা হয়েছে।
ড. এম উমর চাপরা প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও নিষ্ঠাবান ইসলামী স্কলার। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের ইসলামী গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (আরটিআই)-এর গবেষণা উপদেষ্টা। ১৯৬৫ সালের জুলাই থেকে বর্তমানে তিনি রিয়াদস্থ সউদী এরাবিয়ান মনিটারী এজেন্সীতে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়াও তিনি শিক্ষকতা ও গবেষণা ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন (প্লেট ভিলা) এবং দ্য ইউনিভার্সিটি অব কেনটাকী-লেক্সিংটন -এর অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। অর্থনীতির শিক্ষাদানে তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৬টি এবং প্রবন্ধ সংখ্যা শতাধিক। তিনি ইসলামি অর্থনীতি ও ফিন্যান্স-এর ওপর ব্যাপক লেখালেখি করেছেন। বিশেষভাবে এবং ব্যাপকভাবে প্রশংসিত তাঁর অন্যতম গ্রন্থসমূহ হচ্ছে- ‘টুয়ার্ডস এ জাস্ট মনিটারী সিস্টেম (১৯৮৫)’, ‘ইসলাম এন্ড ইকনোমিক ডেভেলপমেন্ট (১৯৮৮)’, ‘ইসলাম এন্ড দি ইকনোমিক চ্যালেঞ্জ (১৯৯২)’, ‘দা ফিউচার অব ইকোনোমিকস: এন ইসলামিক পারসপেকটিভ (২০০০)’ এবং ‘মুসলিম সিভিলাইজেশন: দ্য কজেজ অব ডিক্লাইন এন্ড দ্য নীড ফর রিফর্ম (২০০৭)’। ইসলামি অর্থনীতি ও ফিন্যান্স-এ বহুবিধ অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৯ সালে ‘ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পুরস্কার’ এবং ১৯৯০ সালে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে ‘বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ লাভ করেন। তিনি ১৯৬১ সালে মনোটারী ইকোনমিক-এর উপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ইসলামের মূল উৎস কুরআন-সুন্নাহ থেকে সরাসরি জ্ঞান লাভের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে তিনি আরবি ভাষা শিখেন এবং ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন করেন। এভাবেই তার মধ্যে ইসলামী ও পাশচাত্য জ্ঞানের এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটে। ১৯৩৩ সালে সৌদি আরবে জন্মগ্রহণকারী চাপরা ছাত্র জীবনে ছিলেন অসাধারণ মেধার অধিকারী। তিনি ১৯৫০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় করাচী ও সিন্ধু-এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারের গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে করাচী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.কম পাশ করার পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯৬১ সালে “মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়, মিনিয়াপোলিস থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য বিভাগীয় প্রধান উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত দেশ-জাতি নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সেরা ছাত্র বলে তার প্রশংসা করেন। একসময়ে তিনি পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকনোমিকস এর সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ও পাকিস্তান ডেভেলপমেন্ট রিভিউ- এর সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। অতঃপর পাকিস্তান সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ- এ রিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ অত্যন্ত সাফল্যের সাথে বিভিন্ন্ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বস্তুত শিক্ষা, গবেষণা এবং নীতি নির্ধারণ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জনের বিরাট সুযোগ ড. চাপরা পেয়েছেন। তিনি অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স-এর উপর বহু সংখ্যক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। এসব সেমিনার ও সম্মেলনে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।