"চাঁদের অমাবস্যা" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: চাঁদের অমাবস্যা: প্রাসঙ্গিক ভাবনা চাঁদের অমবস্যা মনােবিশ্লেষণধর্মী উপন্যাস। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এতে চেতনাপ্রবাহরীতির নিরীক্ষা চালিয়েছেন এবং একইসঙ্গে মানবমনের চেতনঅবচেতনের দোলাচলে শেষ পর্যন্ত মানুষকে সত্য ও সুন্দরকেই আলিঙ্গন করতে হয়: সেই রূপটি চিত্রায়ণ করেছেন। পৃথিবীতে মানুষ এসে পশুর মতাে খেয়ে পরে প্রস্থান করলেই তাঁর কাজ শেষ হলাে না। তার পরিবার থাকে, সমাজ থাকে, থাকে রাষ্ট্র, বিশ্ব ; সাহিত্য ও সভ্যতা। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ নিরন্তর সংগ্রাম করে ; দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য তাকে কাজ করতে হয় ; কিংবা তাকে অবৈধপন্থা অনুসন্ধান করতে হয়। মানুষ যাই করুক; তাকে সুন্দরের গান গাইতে হয় ; সত্যকে আলিঙ্গন করতে হয়। এই সত্য ও সুন্দরকে আলিঙ্গন করতে কিংবা প্রতিষ্ঠিত করতে তার জীবনে নেমে আসে সমূহ বিপদ। জীবনে যতই বিপর্যয় নেমে আসুক; তাকে সকল বিপত্তি অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত সত্যকে গ্রহণ করতে হয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লার সাহিত্যভাবনা স্বতন্ত্র ও বিশেষভাবে নিরীক্ষিত। তিনি রসালাে কথার ফুলঝুরি দিয়ে সাহিত্য নির্মাণ করতে চান নি। তিনি জীবনের গভীরতর স্তরে পৌঁছে মানব রহস্যের দ্বার উন্মােচন করতে বদ্ধপরিকর। তাঁর তিনটি উপন্যাসই অস্তিত্ববাদ ও চেতনাপ্রবাহরীতি গাণিতিক সূত্রে অন্বিত। তিনি মানুষের বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ের চিত্র যেমন দেখান তেমনি পৃথিবীতে মানুষের মূলত প্রকৃত কাজ কী ? সেই প্রকৃত কাজের অনুসন্ধান করতে শেষ পর্যন্ত তিনি সত্য ও শুদ্ধতার প্রসঙ্গ টানেন। চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে আমরা দেখেছি যুবক শিক্ষক আরেফ আলী পরবর্তী সব ঘটনা অনুধাবন করে, সমূহ সকল বিপত্তির কথা চিন্তা করে হত্যা ও ধর্ষণের কথা আদালতে প্রকাশ করে দেয়। ক্ষমতা ও আইনের ফাঁকে ও প্যাঁচে পড়ে তাকেই অন্ধকার কারাগারের প্রকোষ্ঠে অন্তরীণ হতে হয়। জীবনের সমূহ বিপদ নিশ্চিত জেনেও মা ও বােনদের অনিকেত পরিস্থিতি ও নিজের চাকরিচ্যুতির কথা চিশত্ম করে একমাত্র সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা এবং নিজে শুদ্ধসত্তায় উত্তীর্ণ হওয়ার মানসে হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা আদালতে প্রকাশ করে। ফল যা হবার তাই হয় ; নিজেই বন্দি হয়। যদিও সে বন্দি তবু মুক্তজীবনের আস্বাদে আনন্দিত। কেননা না সে নিজের কাছে সত্য লুকোবার অপরাধে আর অপরাধী নয় ; সে সংকীর্ণতা থেকে সে মুক্তি পেয়েছে ; শুদ্ধসত্তায় উত্তীর্ণ হয়েছে। ঔপন্যাসিক গ্রাম স্কুল শিক্ষকের জীবনকে নির্বাচন করে উপন্যাসের পটবিন্যাস করেছেন। সাহিত্য বিচারকগণ সাহিত্যের উদ্দেশ্য নিয়ে পরস্পর বিরােধী মতামত প্রদান করলেও সাহিত্য যে সত্য ও সুন্দরের প্রকাশ তার গাণিতিক ব্যাখ্যা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কাছে নতুনভাবে পাওয়া যায়। তিনি মানুষের ক্লেদাক্ত ও বীভৎসরূপ অঙ্কনসূত্রে দেখান যে, মানুষকে এভাবে বাঁচতে হয় ; মানুষ এভাবে বাঁচে।
Syed Waliullah (তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট) তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে কোলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড়ো মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতি হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং স্ত্রী ওয়ালীউল্লাহর বড়ো মামী ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।