শিখা ব্যাতিক্রম ধরনের মেয়ে। অন্য সব মেয়েদের মতো তার আচরণ, ভঙ্গিমা কিন্তু তাদের চেয়ে একটু আলাদা ধাঁচের। সারাদিন গ্রামের আঁকাবাকা মেঠোপথে হৈচৈ করে ঘুরে বেড়ানো, পুকুর থেকে শাপলা ফুল তোলা এবং বান্ধবীদের সাথে আড্ডা মেরে সময় কাঁটানো তার নেশা। তার চেয়ে বড় নেশা গাছে উঠা, আমগাছ, পেয়ারাগাছ, জামগাছে উঠে ফল পেড়ে খাওয়াটাই তার বড় নেশা। শিখা খুবই দূরন্ত ও চঞ্চল্য প্রকৃতির মেয়ে। তার পুরো নাম দীনিয়া সুলতানা শিখা। তার বাবা তাকে আদর করে শিখা বলে ডাকে। তার হাসি যেন প্রিন্সেস ডায়নাকে হার মানায়, আঁখি দুটি হরিণের মত, গোলাপী রাঙা দুটি ঠোঁট, জলভরা নবমেঘের মতো নধর দেহ, ¯িœগ্ধ শ্যামল, চুলের বাহার যেন নদীর ঢেউয়ের মতো চলমান বয়ে যায়। তার কন্ঠ একটু হালকা, কিন্ত মিষ্টি ও সুরেলা। তার আলতা রাঙা দুটি পায়ের নপুরের ঝংকার মনে অফুরন্ত আনন্দের দোলা দিয়ে যায়। ভরা ফাগুন মাসে ভ্রমর যেমন, ফুল বাগিচার চারপাশে গুনগুন করে, ঠিক তেমনি শিখার চারপাশে সর্বদা ছেলেদের আনাগোনা বিরাজমান। যেকোন ছেলে শিখাকে দেখলে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যায়! শিখার ঐ চাহনিতে দু’চোখের বাহনিতে ছেলেদের হৃদয়ের মনিকেীঠায় উতাল-পাতাল ঢেউ তুলে দেয় কিন্তু সে ছেলেদের পাত্তা দেয় না।। শিখার সৌন্দর্য সুগঠিত পরিপাটি শারীরিক গঠন, সব ছেলেদের ঘায়েল করে কিন্তু তার সাথে প্রেম করার বৃথা চেষ্টা করে লাভ কি? তার কাছে ছেলেদের কোন দাম নেই। নেই কোন চাহিদা, তার কাছে কোন ছেলেই যেন রাজপুত্র নয়! কুয়াশা যেমন চারিদিক আচ্ছন্ন করে, শিশিরের বিন্দু যেমন ঘাসের বুকে জায়গা খুঁেজ, মেঘের গর্জনে যেমন বৃষ্টির আগমন ঘটে, তেমনি শিখার সুগঠিত, সুশীল, পরিপাটি দেহের ভঙ্গিমায় সৌন্দর্যের মহিমা ছেলেদের মোহিত করে তোলে। এক কথায় শিখা রূপবতী ও লীলাবতী কন্যা। তার সৌন্দের্যের জাল্লা দেখে সবাই মূঢ় হয়ে যায়। বিধাতা যেন নিজের হাতে তাকে সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ও রুপ তাকে দান করেছেন। আসলে বিধাতার সৃষ্টি বুঝা দায়, কখন কিভাবে কাকে কী করবেন, সেটা তার মর্জি। শিখা বরিশাল জেলার অন্তর্গত কদমতলী গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা আসলাম মির্জা আর মা ফাতেমা-তুজ-জোহরা (পান্না)। সংক্ষেপে পান্না বেগম। তার চাচা সামাদ মির্জা ও বড় ফুঁফু কুসুম বেগম। শিখার বাবা আসলাম মির্জা কদমতলী গ্রামের মাতবর। তাকে সবাই সম্মান ও শ্রদ্ধা করে এবং ভয় পায় কারণ সে একটু উগ্র মেজাজের লোক। যখন যা বলে তাই করে! এক রোখা এবং চৌকস মানুষও বটে। গ্রামের যত ধরনের বিচার-শালিশ রয়েছে, সব শিখার বাবা আসলাম মির্জা নির্ণয় করেন। সে উগ্র মেজাজের লোক হলেও সর্বদা সত্য ও ন্যায় বিচারক। সত্য ও ন্যায়ের জন্য সর্বদা লড়াই করেন এবং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজেকে বলিদান দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না। কখনো তিনি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন নি। আসলাম মির্জা অগাধ সম্পদের মালিক। কদমতলী গ্রামে তার প্রায় ২০-৩০ বিঘা জমি আছে। এছাড়া ৫টি পুকুর, ১২টি অস্ট্রলিয়ান জাতের দুগ্ধ গাভি, দুটি ফলের বাগান রয়েছে। তার ফলের বাগানে উন্নত জাতের সর্ব প্রকারের ফল ধরে। প্রকৃতপক্ষে কোন কিছুর-ই অভাব নেই তার। আসলাম মির্জার একমাত্র মেয়ে শিখা এবং ছোট ছেলে সিকু। আসলাম মির্জার এই অগাধ সম্পদের মালিক শিখা ও সিকু। আসলাম মির্জার বড় বোন অর্থাৎ শিখার ফুফুকে বিয়ে দেয়া হয়, বাঘেরহাট জেলার অন্তর্গত চিতলমারী গ্রামের বাসিন্দা কলিমউল্ল্যাহ শেখ ওরফে কলিম শেখের সনে। কলিম শেখ পেশায় একজন সরকারি কর্মকর্তা। সে বাগেরহাট জেলায় মৎস্য অধিদপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। এখন অবশ্য সে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কলিম শেখ এখন টুকিটাকি ব্যবসা করেন। তার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। বাগেরহাট জেলায় তার নিজস্ব একটি বিশালাকার মার্কেট রয়েছে। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামায় জামাতের সহিত আদায় করেন। তার স্ত্রী কুসুম বেগমও পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করেন। কলিম শেখের বড় ছেলে দেশে থাকে আর কনিষ্ট ছেলে থাকে সুইডেন। কলিম শেখও অগাধ সম্পদের মালিক। তিন তলা একটা বাড়ি, চারটি পুকুর, ডেইরি ফার্ম এবং বৃহৎ আকারের একটি মৎস্য খাঁমারের মালকিন। কলিম শেখের ব্যবসা রমরমা। কলিম শেখ নিজেই এই সব দেখাশুনা করেন। মাঝে সাঝে মিলন শেখ তাকে সাহায্য করে। কলিম শেখের জেষ্ঠ্য পুত্রের নাম মিলন শেখ। আর কনিষ্ট ছেলের নাম রিমন শেখ। ছোট ছেলে রিমন শেখ পড়াশোনার জন্য বিদেশে থাকে এবং বড় ছেলে মৎস্য অধিদপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তা। মিলন সিনিয়র অফিসার এবং উচ্চ বেতনস্থ। কনিষ্ট ছেলে রিমন শেখ নিজ অঞ্চল থেকে এসএসসি পাশ করার পর পড়াশুনা করতে সুইডেন চলে যায়। কলিম শেখের কোন মেয়ে নেই। কলিম শেখকে পর পর দুটি ছেলে সন্তান প্রদান করেছে মহান আল্লাহ। কিন্তু কোন মেয়ে তাকে দান করেন নি পরম করুণাময়। শিখার ছোট চাচা অর্থাৎ কলিম শেখের ছোট শালাবাবু সামাদ মির্জারও কোন মেয়ে নাই। তার একটি মাত্র ছেলে নাম টিটু মির্জা। সে একটা আধ্যাত্মিক ধরনের ছেলে। তার চোখ দুটো বড় বড়, চুলগুলো বিক্ষিপ্ত, গাল দুটো ভাঙ্গা, উগ্রচন্ডী ও ভিরাক্কি ধাঁচের। তার কাঁনে সব সময় হেডফোন লাগানো থাকে। হাঁটতে হেডফোন, খেতে বসলে হেডফোন, পড়তে বসলে হেডফোন, শুতে গেলে হেডফোন। এককথায়, হেডফোন ছাড়া তার অন্য কোন কাজই চলে না। সে একজন দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে। সে বরিশালের বি.এম কলেজে অনার্স ২য় বর্ষে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত ছাত্র। কিন্তু সে দুষ্ট স্বভাবের। কলেজের আঙিনায়, রাস্তাঘাটে, মোবাইল ফোনে, ফেসবুকে সবসময় মেয়েদের বিরক্ত করে। তার বাবা-মা, জেঠা-জেঠি, এমনকি তার জেঁঠাতো বোন শিখাও তার প্রতি অতিষ্ঠ। তাকে কেউ পছন্দ করে না। তার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। সে একজন দুষ্ট চরিত্রের ছেলে। তার পড়াশুনার প্রতি কোন আগ্রহ নেই, নেই কোন মাথা ব্যাথা। সে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক টানাটানি করে পাশ করে। এখন তার একমাত্র কাজ মেয়েদের শুধু ডিসটার্ব করা আর বেকার ঘুরে বেড়ানো। শিখার ফুফু কুসুম বেগমের কোন মেয়ে নেই। দুটি ছেলে মিলন শেখ ও রিমন শেখ। রিমন শেখ বিদেশ থেকে মাঝে মধ্যেই ফোন দিয়ে খোঁজ-খবর নেয়, বাবা-মা ও ভাইয়ের। কুসুম বেগমের বাড়ি সর্বদা ফাঁকা থাকে। তাই তাঁর সর্বদা একাকিত্ত্বে দিন কাটে। তার বাড়িতে কোন মেয়ে নেই যে, একটু প্রাণ খুলে কথা বলবে, হই-হল্লোর করে বাড়ি মাথায় তুলবে। হাসাহাসি করবে, কথার ছলে মন মাতিয়ে তুলবে। তার ইচ্ছা এমন একটিা মেয়ের তার বাড়িতে আগমন ঘটুক, যে হাসাহাসির ছলে আনন্দ কৌতূহলে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখবে। শিখাকে শিখার ফুঁফু কুসুম বেগম খুব পছন্দ করে, অনেক ভালও বাসে। এই জন্যে তিনি শিখার বাবা আসলাম মির্জাকে বলেন, শিখাকে তার বাড়ি অর্থ্যাৎ বাগেরহাট নিয়ে যেতে চান। বড় বোন বলে আসলাম মির্জা কথাটি মেনে নেয় এবং শিখাকে তাদের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। বরিশাল কলেজ থেকে শিখাকে চিতলমারী সরকারি কলেজে স্থানান্তর করা হয়। শিখার ফুঁফুর বাড়ি থেকে তার কলেজ ৩০ মিনিট হাঁটার পথ। রিক্সা অথবা অন্য কোন যানবাহন দিয়ে যেতে মাত্র ১২ মিনিট সময় লাগে। শিখা চিতলমারী কলেজে যেতে যেতে এখন আর অলসতা কিংবা লজ্জাবোধ করে না। সে এখন পুরোনো ছাত্রীর মতো অভ্যস্থ। শিখার একজন প্রিয় বান্ধবী আছে, তার নাম আঞ্জুমান আরা ওরপে আঞ্জু। সবাই তাকে আঞ্জু বলেই ডাকে। শিখাও তাকে আঞ্জু বলেই ডাকে। আঞ্জুর বসবাসও বরিশাল। মানে শিখা ও তাদের বাড়ি একই গ্রামে। শিখা ও আঞ্জুর বাড়ি পাশাপাশি এবং দুজন সমবয়সী বলেই তাদের বন্ধুেত্বর বন্ধন সেই প্রাইমারীর শিক্ষা জীবন থেকে। শিখার সাথে আঞ্জুর দহরম-মহরম সর্ম্পক। তাদের দু’জনের বন্ধুত্বের বন্ধন অনেক দৃঢ়। তারা দু’জনেই অন্তরঙ্গ বন্ধু। তারা দুজন একে অপরের অংশ কেননা সেই ছোট বেলা থেকে একই সাথে স্কুলে যাওয়া, একই স্কুলে একই শ্রেণিতে পড়া, এক সাথে বাসায় ফেরা, প্রাইভেট পড়তে যাওয়া, যে কোন কিছু ভাগাভাগি করে নেওয়ার মজাটা তারা দু’জন বেশি উপভোগ করে। এমনকি দুজন একই সাথে খাবারটা পর্যন্তও খেতে পছন্দ করে। সত্যিকার অর্থে, একজন আরেকজনের প্রাণ। সেই প্রাণপ্রিয় বান্ধবিকে ছেড়ে আসাতে শিখার মনটা কখনোসখনো অজান্তে কেঁদে ওঠে। যখন শিখা তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবিকে ছেড়ে তার ফুফুর বাড়িতে চলে আসে, তখন তার কাছে মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন তার কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছে, কি যেন রেখে এসেছে। তখন অজান্তেই তার দুই নয়নে বৃষ্টির মতো অঝোর ধাঁরে অশ্রু ঝরতে থাকে। কুসুম বেগমের বাড়ি অথ্যাৎ চিতলমারি আসার পর শিখার আর কোন কিছু ভাল লাগে না, তার মন স্থির করতে পারছেনা। তার মন শুধু তার বান্ধবির জন্য আনচান করে ও সর্বদা অস্থির থাকে। তার ফুফু তার এই করুণ অবস্থা দেখে তাকে একটি বেশী দামীও ভিডিও ফোন কিনে দিল। সাথে বিনোদন এবং শিক্ষামূলক কাজ করার জন্য একটি কম্পিউটারও কিনে দেয়। এতে শিখা অনেক স্বার্চ্ছন্দ্যবোধ করে ও আপ্লুত হয় এবং নিয়মিত তার বান্ধবির সাথে যোগাযোগ করতে পারে, কথা বলতে পারে এবং ইচ্ছেমতো ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুজন দু’জনকে দেখতে পারে। যার কারণে এখন শিখাকে আর অন্যমনষ্ক দেখায় না। এখন তাকে দেখলে