“বিজ্ঞানের বহু গতিপথ" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ২০০৬ সালে নাসা মহাকাশযানটিকে পাঠায়। দ্রুততম গতি নিয়েই ছুটেছে এটি বামনগ্রহ প্লুটোর পথে। অবশ্য মিশন শুরুর সময় প্লুটো গ্রহই ছিল। ২০১৫ এর ১৪ জুলাই এটি পুটোর সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছায়। তখনি ছবি তুলেছে মহাকাশযানটি। এ ছবিগুলাে হাবল টেলিস্কোপের চেয়ে হাজারাে গুণ পরিষ্কার। নিজ কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে গ্রহটির ১৪৮ বছর সময় লাগে। এখন পর্যন্ত জানামতে প্লুটোর ৫টি উপগ্রহ রয়েছে। শুধু দুটোই নয়, এর পাঁচটি উপগ্রহকেও পাশ কাটিয়েছে নিউ হরাইজন। উপগ্রহগুলাে হলাে- স্টিক্স, শ্যারন, নিক্স, হাইড্রা ও কেরবেয়ােস। সৌরজগতে সূর্যের সবচেয়ে দূরে থাকায় দুটোর আবহাওয়া হিম শীতল। অ্যান্টার্কটিকায় সবচেয়ে কম তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়েছিল মাইনাস ৮৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পুটোর ভূ-ত্বকের উপরিভাগের তাপমাত্রা মাইনাস ২৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০৬ সালে সেই মহাকাশযান যাত্রা শুরু করেছিল এবং প্লটোর কাছাকাছি পৌঁছতে সময় ব্যয় হয়েছে প্রায় এক যুগের মতাে (৩ হাজার ৪৬৩ দিন)। হরাইজন মিশন এই পথে যাওয়ার সময় একের পর এক ছবি তুলে গেছে বামনগ্রহটির। নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী থেকে মঙ্গল যতটা দূরে, প্লটো তার চেয়েও ৪০ গুণ বেশি দূরে। জেট বিমানে গেলে এই গ্রহে গিয়ে পৌঁছতে লাগত ৭০০ বছর। প্লুটোর দিকে নিউ হরাইজন ছুটেছে সেকেন্ডে ৬৪ কিলােমিটার গতিতে আর ঘণ্টায় ৩৬ হাজার মাইল বেগে। এটাই সর্বোচ্চগতির মহাকাশযান। এই গতিতে নিউ হরাইজন চাঁদে পৌছবে মাত্র ৯ ঘণ্টায় আর অ্যাপােলাে গিয়েছিল ৩ দিনে। হরাইজন এ মিশনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠিয়েছে। এক, প্লুটোর পাহাড় আছে, পুটোর ছােট চাঁদ হাইড্রার আছে জলের বরফ এবং সবচেয়ে বড় চাদ শ্যারনের আছে গিরিখাত। কোটি কোটি কিলােমিটারের পথ কমিয়ে মাত্র ১২ হাজার কিলােমিটারে নেমে এসে এসব তথ্য হরাইজন পাঠিয়েছিল। হরাইজনের সহায়তায় জানা গেছে শ্যারনের এই গিরিখাত এক হাজার কিলােমিটার জুড়ে প্রসারিত এবং ৭-৯ কিলােমিটার গভীর। সম্ভবত শ্যারনের গিরিখাদ গ্রান্ড ক্যানিয়নের চারগুণ লম্বা এবং গভীরতায় ৪ গুণ। এই চ্যুতি এবং গিরিখাত ইঙ্গিত করে অতীতে শ্যারনের মারাত্মক ভূ-তাত্ত্বিক বিশৃক্ষলা। ঐতিহাসিক মহাক্ষণের সময় ঠিক কী দেখেছে- এরকম একটি প্রশ্নে মিশনের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিল, লক্ষ্য ছুঁয়েছে নিউ হরাইজন। একে একে সৌরজগতের সবকটি গ্রহ যন্ত্রসহায়তায় ছুঁয়ে দেখল মানবজাতি। দীর্ঘদিন বিজ্ঞান নিয়ে বক্তৃতা ও লেখালেখির কারণে হরাইজনের এই অভিযান সম্পর্কে এক বিজ্ঞান কর্মীর প্রশ্নের জবাবে একটু থমকে গিয়েছিলাম। সূর্যের দূরতম বামন গ্রহ প্লুটো সম্পর্কে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল অন্য একটি কথা। তাহলাে, নিউ হরাইজন পুটোকে ছুঁয়েছে। এর মানে হলাে, মানুষ ছুঁয়েছে প্রটোকে। আরেকবার সৌরজগতে নিজের শক্তি পরীক্ষা করল মানুষ। সে যদি দেখে, সৌরজগতে সে-ই শক্তিমান, তাহলে স্বপ্ন দেখে একদিন এই সূর্যভিটার যত্রতত্র সে ঘুরে বেড়াবে। এটাই তার ঘর। প্লটোর নতুন চাঁদ কিংবা বলয় খোঁজাই এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য নয়। এই কথাগুলাে হরাইজন মিশনের জ্যেষ্ঠ গবেষক, যুক্তরাজ্যের আরিজোনায় প্লানেটরি সায়েন্স ইনস্টিটিউটে কর্মরত হেনরি গ্রুপকে জানানাে হলে তিনি জবাবে বলেন, ‘আসলেই তা মূল লক্ষ্য নয়। তিনি পুরােপুরি ঠিক কথাটাই বলেছেন। প্লুটোর চাঁদ কিংবা বলয় খোঁজা সম্পর্কে তার মন্তব্য যথােপযুক্ত। চাঁদ ও বলয়ের সন্ধান আমরা করলেও এটাই আসল লক্ষ্য নয়।' মানবজাতিকে সম্প্রসারিত করতেই যেন নিউ হরাইজন মিশন এখন সৌরজগতের আরও প্রান্তের দিকে ছুটছে। কুইপার বেল্টের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়ানাে তার লক্ষ্য। স্বল্প পর্যায়ের ধুমকেতু, ছােট গ্রহাণু, পাথরখণ্ড ধূলিকণা দিয়ে পূর্ণ সৌরজগতের দূরতম এই কক্ষপথ। ২০১৯ সালের পয়লা জানুয়ারি প্রায় ৪০০ কোটি কিলােমিটার দূরে কুইপার বেল্টের মূল অঞ্চলে প্রবেশ করবে মহাকাশযান। তখন পৃথিবী থেকে বেতার যােগাযােগে ৯ ঘণ্টা সময় লাগবে। হয়তাে ভবিষ্যত প্রজন্ম এই অঞ্চলটিকে সৌরজগতের মানবীয় সীমানা হিসেবে চিহ্নিত করবে। মহাকাশ স্টেশনগুলাে ভিনগ্রহীদের হয়তাে অতিথি হিসেবে এখান থেকেই স্বাগত জানাবে।