ভূমিকা কূটনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ ডিপ্লোম্যাসি’র উদ্ভব ঘটেছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ থেকে। কূটনীতি শব্দটি ১৭৯৬ সালে অ্যাডমন্ড বার্ক প্রচলিত ফরাসি শব্দ ফরঢ়ষড়সধঃরব থেকে প্রচলন হয়। ফরাসি কূটনীতিক চার্লস মাউরিস দ্য ট্যালেয়ার্যান্ড-পেরিগোর্ডকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন কূটনীতিক ভাবা হয়। তবে গ্রিক ডিপ্লোমা শব্দটি থেকে ডিপ্লোম্যাসি শব্দটির সৃষ্টি বলে ধারণা করা হয়। ডিপ্লোমা শব্দটি গ্রিক ক্রিয়াশব্দ ‘ডিপ্লোন’ থেকে এসেছে। ‘ডিপ্লোন’ মানে হচ্ছে ভাঁজ করা। ফ্রান্সে ১৭ শতক থেকে বিদেশে অবস্থানকারী বাণিজ্যিক ও সরকারি প্রতিনিধি দলকে কূটনৈতিক দল বলা শুরু হয়। কূটনীতি হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিদ্যার একটি শাখা, যেখানে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক চুক্তি বা আলোচনা সম্পর্কিত কলা কৌশল অধ্যয়ন করা হয়। সাধারণ অর্থে কূটনীতি হচ্ছে কোন রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত সরকারি কার্যক্রম। পর্যটক অ্যান্থনি শার্লে মনে করেন, বিশ্বে পারস্য শাসকরাই প্রথম ইউরোপে (১৫৯৯-১৬০২) পারস্য দূতাবাস খুলেছিল। বাংলা কূটনীতি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘কূটানীতি’ থেকে আগত। প্রথম মৌর্য্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের উপদেষ্টা চাণক্যর (কৌটিল্য হিসেবেও পরিচিত) নাম থেকে ‘কূটানীতি’ শব্দটির উদ্ভব। একটি রাষ্ট্র কেমন তার ওপর নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের কূটনীতির ধরন। বাংলাদেশ হলো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা এই সকল নীতি হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সব নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র: (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ, পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায়-অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণ বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাইকেল করগ্যান একজন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ। তবে তার বিশেষায়িত জ্ঞান রয়েছে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের কূটনৈতিক উৎকর্ষ বৃদ্ধির বিষয়ে। একটি ছোট্ট দেশের নাম আইসল্যান্ড। লোকসংখ্যা মাত্র সোয়া তিন লাখ, আয়তনে ৩৯,৭৭০ বর্গমাইল। কিন্তু পেশাগত কূটনৈতিক জ্ঞান অর্জন করে তারা বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে। আইসল্যান্ড তাই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের কূটনীতির এক মডেল। আইসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর স্মল স্টেট স্টাডিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মি. করগ্যান তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মার্কিন নৌ একাডেমীর স্নাতক করগ্যান নৌবাহিনীতে ২৫ বছর চাকরি করেন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল ন্যাটো সম্পর্কিত। ১২ আগস্ট ২০০৮ তিনি এক নিবন্ধে লিখেছেন, কয়েক বছর আগে কাউন্সিল অব ইউরোপের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ এলো বিশ্বের অন্যতম লিলিপুট রাষ্ট্র মাল্টার সামনে। লোকসংখ্যা সোয়া চার লাখ। তো এই মাল্টা যখন ওই আমন্ত্রণ পেলো তখন তাদের কূটনীতিকরা মহা বিপদে পড়লেন। ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করলেন, কী করে এত বিশাল কাজ তারা সামলাবেন। তারা যদি তাদের সমস্ত কূটনৈতিক সার্ভিসকে এই কাজে ব্যস্ত রাখেন তাহলেও যতো লোকবলের দরকার পড়ে তার মাত্র অর্ধেকটাই পূরণ হয়। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সামনে বাস্তবতা হলো, সে যতোই ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে থাকতে চাক না কেন, বিশ্বায়ন ও বৈশ্বিক রাজনীতির ক্রম সম্প্রসারণশীল প্রভাব থেকে তার পুরোপুরি মুক্তি নেই। আঞ্চলিক বা বিশ্বশক্তির উপরে তার তেমন কোনও প্রভাব না থাকতে পারে। কিন্তু কূটনীতির ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো সমরাস্ত্র দিয়ে যা পারে না কিংবা সেটা পারার কোনও প্রশ্নই আসে না, তদুপরি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে বেশি কিছু করতে পারে। এজন্য তার হাতে থাকে আরেকটি অস্ত্র। আর সেটি হলো শাণিত কূটনীতি। এটির যথাযথ ও দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে সে নিজের মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে। বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চেও তার প্রভাব এমনকি হতে পারে ‘স্পষ্টত বোধগম্য’। কিন্তু সেটা কিভাবে হতে পারে? সাধারণত বলা হয় পররাষ্ট্রনীতি আর কিছুই নয়, এটি আসলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি বর্ধিতাংশ। বাংলাদেশের অস্থির, ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও রাজনীতি মনে রাখলে তার বৈদেশিক নীতির দোদুল্যমান অবস্থা আঁচ করে নিতে খুব কষ্ট হয় না। বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও তার ভৌগোলিক অবস্থানই বাংলাদেশ কূটনীতির জন্য এক অপ্রতিরোধ্য বিভাজন রেখা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কেউ কেউ মনে করেন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সামনে দুটো বিকল্প থাকে। বড়ো শক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কিংবা কিউবা বা উত্তর কোরিয়ার মতো ‘শজারু’ হয়ে থাকা। বিশ্বায়নের আগে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তপস্বীর মতো দিন কাটানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু সে যুগ হয়েছে বাসি। গুগল আর্থ আজ বিশ্বের প্রত্যেক নাগরিক ও স্থানের চিত্ররূপ আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই বিশ্বের দেশে দেশে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক জোট ও সংস্থা নানাভাবে বেড়েই চলেছে। সার্ককে ঘিরে অবশ্য এখনও তেমন প্রায় কিছুই গড়ে উঠেনি। কিন্তু আসিয়ানকে ঘিরে ইতিমধ্যে নানা ধরনের প্রভাবশালী সংস্থার উšে§ষ ঘটেছে। সে সব সংস্থার অনেকগুলোই আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যেও সীমাবদ্ধ নেই। তামাম দুনিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলো আজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসিয়ানের আর্শিতে মুখ দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। জার্মানির ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তিচুক্তি বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ১৬৪৮ সালে সম্পাদিত এই চুক্তি হোলি রোমান অ্যাম্পায়ারের ত্রিশ বছরের (১৬১৮-১৬৪৮) এবং স্পেন ও ডাচ্দের মধ্যকার আশি বছর (১৫৬৮-১৬৪৮) দীর্ঘ যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল। বন্দুকের নল নয়, কূটনীতিই শান্তি বয়ে এনেছিল। আজ আমরা বিশ্বের রাষ্ট্রের যে কাঠামো দেখছি সেজন্য সপ্তদশ শতাব্দীর ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র ভেনিসের কূটনীতিকদের অবদান অপরিসীম। তারাই ইউরোপের যুদ্ধের বিভীষিকা স্তিমিত করে দিয়েছে। ১৯৬২ সালের ভিয়েনা ডিপ্লোমেটিক কনভেনশন ছাড়া সারা দুনিয়ার কূটনীতি অচল। এই কনভেনশনে আমরা দেখি, ‘নাংশিও’ নামে একটি পদবির স্বীকৃতি। বিদেশে পোপ এর দূত বা প্রতিনিধিদের বলা হয় ‘নাংশিও’। এঁরা রাষ্ট্রদূত পদমর্যাদার সমতুল্য। সত্যি বলতে কি, হলি সি’ (ভ্যাটিকান)-এর কূটনীতিকরা শত শত বছর ধরে কূটনীতিতে যে ভূমিকা পালন করে আসছিলেন, তারই স্বীকৃতি হিসেবে ওই ‘নাংশিও’ শব্দের স্বীকৃতি। আধুনিককালে বিশেষ করে সুইজারল্যান্ড এবং নরডিক দেশগুলো সন্দেহাতীতভাবে দেখিয়েছে, কি করে জ্ঞান ও বিদ্যা-বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে কূটনীতিতে মনোনিবেশ করলে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তার নিজ অনুকূলে অবিস্মরণীয় সুফল বয়ে আনতে পারে। বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযোগ্য অর্থনীতি কিংবা নিরাপত্তাগত স্বার্থ জড়িত থাকে। ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তগুলোর অন্যতম হিসেবে এ্যাংলো-নরওয়েজিয়ান ফিসারিজ মামলাটিকে দেখা হয়। এই ঘটনাকে অনেকেই বিশ্ব কূটনীতিতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মাইলফলক বিজয় হিসেবে গণ্য করে। কারণ এই রায় দেখেই আইসল্যান্ড তার জলসীমা ৪ মাইল থেকে ১২ মাইলে উন্নীত করে। পরবর্তী সিকি শতাব্দী জুড়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো সমুদ্র আইন প্রক্রিয়াগুলোর সঙ্গে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করেছে। এর ফলে সার্বজনীন মাছ ধরার সীমা এখন ২০০ মাইলে উন্নীত হয়েছে। সমুদ্র আইনে ‘কমন হেরিটেজ অব ম্যানকাইন্ড’ নামে একটি বিরাট অর্জন রয়েছে। গভীর সমুদ্রের তলদেশে থাকা সম্পদের ভাগাভাগি এর সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশসহ সকল ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এজন্য যার কাছে ঋণী হতে পারেন, তিনি হলেন অরভিধ পার্দো। তিনি ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত মালটার কূটনীতিক। প্রধানত বৃহৎ দেশগুলোর কব্জায় থাকা এই সম্পদের হিস্যা পেতে তিনিই ওই ধারণার প্রবক্তা। দেখার বিষয়, আনক্লজ হিসেবে পরিচিত জাতিসংঘ সমুদ্র আইন যখন কার্যকর হয় তখন এর আওতায় অনেক ফোরামে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তা কাজে লাগাতে সেভাবে সচেষ্ট হতে দেখা যায়নি। শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেক সময় অনৈক্য ও অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন কালো ছায়া ফেলেছে। ১৯৭৫-৭৬ সালে সর্বশেষ কড যুদ্ধ (মূলত সমুদ্রসীমা বিরোধ) হয়েছিল। ওই সময়ে বৃটেন এবং আইসল্যান্ডের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে যায়। কিন্তু একজন দক্ষ আইসল্যান্ডিক কূটনীতিক হেলগি অগাস্টসন কায়দা করে বৃটেনে থেকে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বসেই পরে নানাভাবে তার দেশের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। এই বিরোধ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান এতোটাই গভীর ছিল যে, বিবিসি নিয়মিতভাবে ব্রিটিশ কূটনীতিকদের বাদ দিয়ে তাঁর কাছ থেকেই মতামত নেয়া শুরু করে। আর সেই সুযোগে তিনি তাঁর নিজের দেশের সমস্যার কথা বৃটেনবাসী তথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হন। অধ্যাপক মাইকেল করগ্যান তাঁর ওই নিবন্ধে দেখিয়েছেন, ন্যাটোর সামগ্রিক রূপরেখার মধ্যে বাল্টিক দেশগুলোর জন্য নিরাপত্তাগত কাঠামো পুনর্বিন্যাস করার প্রয়োজন পড়েছিল। দুই জার্মানির একত্রীকরণের পরে ১৯৯৩ সালের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় বৃটেন, জার্মানি, নরওয়ে ও ডেনমার্ক যুক্ত ছিল। ওই সমঝোতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক বিশেষজ্ঞ ড. থমাস-ডুরেল ইয়ং মন্তব্য করেছেন যে, বৃটেন জার্মানি ও নরওয়ে ন্যাটোর উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। একমাত্র লাভবান হয়েছিল ক্ষুদ্ররাষ্ট্র ডেনমার্ক। অথচ তার সামরিক ক্ষমতা ছিল ওই দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। এর একটাই কারণ ছিল, ডেনিস কূটনীতিকরা ন্যাটো সংস্কৃতি ও তার চুক্তিগুলোর প্রভাব সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জ্ঞান রাখতেন। হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত গঠন নিয়ে কয়েক দশক ধরে আলোচনা চলেছিল। এটা এখন যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার প্রশ্নে বিশ্ব জুড়ে যথেষ্ট আলোচিত। তবে এর শুরুটা ছিল কিন্তু ভিন্নরকম। ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় মাদক চোরাচালানিদের নিয়ে বিরাট ঝামেলায় পড়েছিল। এই দুই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সফল দূতিয়ালির কারণে এ আদালত কার্যকর হয়েছিল। আরও লক্ষণীয় ১ জুলাই ২০০২ আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত কার্যকর হয়েছিল যে রাষ্ট্রের দ্বারা রেটিফাই (অনুসমর্থন) করার মধ্য দিয়ে, সেটা কিন্তু ক্ষুদ্র রাষ্ট্র মাল্টা। বাংলাদেশও এটা রেটিফাই করেছে। কিন্তু মাল্টার মতো ঐতিহাসিক তাৎপর্য সৃষ্টি করার কৃতিত্ব অর্জন করে নয়। কোনও রাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিপত্তিতে আয়তন নিশ্চয়ই বিরাট ফ্যাক্টর। বাংলাদেশ বা কোনও ক্ষুদ্র রাষ্ট্র চাইলেই তার সীমানা বাড়াতে পারে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত একজন ভারতীয় হাইকমিশনার বলেছিলেন, ‘বউ বদলানো যায়, প্রতিবেশী বদলানো যায় না।’ কিন্তু উপরের আলোচনায় আমরা দেখলাম, বদলা-বদলির চিন্তা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে যদি কূটনীতিটা দক্ষতা ও অধিকতর জ্ঞানের ভিত্তিতে করা সম্ভব হয়। ১৯৯১ সালে কুয়েতে আগ্রাসন চালিয়েছিল ইরাক। ইতিহাসে এটাই প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। আমি অবশ্য মোটামুটি দুটি যুদ্ধকেই কিছুটা কাছাকাছি থেকে অবলোকন করতে সচেষ্ট ছিলাম। কুয়েতি ঝটিকা কূটনীতি এতটাই সফল ছিল যে, তারা দ্রুততার সঙ্গে জাতিসংঘের আওতায় একটি কোয়ালিশন বাহিনী গঠন করেছিল। ঠিক এমনটা কিন্তু ১৯৩৬ সালে ইথিওপিয়া পারেনি। ইতালি ইথিওপিয়ায় আগ্রাসন চালানোর পর তৎকালীন লিগ অব নেশন্স নিষ্ক্রিয় বসেছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পেশাদারি কূটনীতির মান বর্তমানে দেশের আর পাঁচটা সেক্টর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। অনেকেই বলছেন, এর মান নিম্নমুখী। দলীয়-দূষণে জেরবার পেশাদারিত্ব। আমাদের কূটনীতি অবশ্যই অধিকতর কুশলী, বুদ্ধিদীপ্ত ও জ্ঞানসমৃদ্ধ হতে হবে। এ জন্য প্রযুক্তিগত প্রায় সব ধরনের অনুকূল অবকাঠামো আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে, যেমনটা অতীতে ছিল না। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের ভূমিকার কথাও বলতে হয়। আশির দশকে পররাষ্ট্র দফতর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কূটনীতিকের উজ্জ্বল পদচারণায় ভাস্বর ছিল। ফারুক আহমেদ চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান, নজরুল ইসলাম, শফি সামি, হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, হেমায়েত উদ্দিন ও বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস তাদের অন্যতম। ড. খলিলুর রহমানের নামও উল্লেখ করতে হয়। তাঁদের সঙ্গে প্রায় প্রতিনিয়ত মতবিনিময় হতো। আমার পেশাগত জীবনের একটা ভালো সময় কেটেছে তাঁদের সঙ্গে। আমি এখন উল্লেখ করবো আরও একটি নাম, তিনি এখন শাসক দলের এমপি। তিনি হচ্ছেন মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ। এক সময় ইন্ডিয়া ডেস্কের দায়িত্বে ছিলেন। অসাধারণ কূটনীতিক। অত্যন্ত ভাল মানুষ। ভালো বন্ধু। সিনিয়র ফ্রেন্ড। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে তাঁর কাছ থেকে কোন তথ্যই বের করা যেত না। কিছু যদি অন্য সূত্র থেকে পেয়ে তাঁকে গিয়ে বলতাম, তিনি কখনও শুধু হাসতেন। তবে হাসলেই বুঝতাম এটা সত্য। একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিকের মতো অনার করতেন। অসাধারণ মনের চমৎকার একজন অমায়িক মানুষ। আমাদের ধারণা ছিল, তিনিই হয়তো একসময় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাবেন। যাই হোক এটা রাজনীতির খেলা। সর্বশেষ তিনি রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন। তখন যারা ফরেন অফিস কাভার করতেন, তাদের মধ্যে বাসস’র জগলুল আহমদ চৌধুরী, ইউএনবি’র শামীম আহমেদ, শেখ রকিব উদ্দিন, অবজারভারের নূরুল হুদা, দৈনিক বাংলার প্রয়াত জহিরুল হক ও এপি’র ফরিদ হোসেন ছিলেন। প্রেস ব্রিফিংয়ের মেজাজ ভিন্ন ছিল। বৃটেনের আদলে আমাদের আলাপচারিতায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ফরেন অফিস হিসেবেই উল্লেখ করি। প্রতি বৃহস্পতিবার একটা ব্রিফিং নির্ধারিত ছিল। জরুরি ইভেন্টস হলে ডেকে পাঠানো হতো। বলা হতো যে আজকে ফরেন সেক্রেটারি, ফরেন মিনিস্টার বা পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কথা বলবেন। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে মুখপাত্র নিয়োগ করেছে বলে জানা যায় না। বহিঃপ্রচার অনুবিভাগের মহাপরিচালক অনেক সময় ব্রিফিং করেছেন। কিন্তু তা ঠিক মুখপাত্র হিসেবে নয়। শুরুর দিকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, পরে মন্ত্রী ব্রিফিং করতেন। তো এসব মিলিয়ে ওই সময় অন্য রকম ছিল। রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কারের সময় বহিঃপ্রচার অনুবিভাগের মহাপরিচালক ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম। বর্তমানে দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর সম্পাদক। সাংবাদিকদের সহযোগিতা দিতে উদগ্রীব থাকতেন। তাঁর কাছে ওই ঘটনার সত্যতা জানতে চেয়েছিলাম। তিনি হ্যাঁ বা না কিছুই বলা থেকে বিরত থাকেন। সেই রিপোর্ট স্কুপ হয়েছিল। সম্ভবত আমেরিকাকে খুশি করতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এ আর এস দোহা এটা চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্ত সুচিন্তিত ছিল না। ফরেন অফিস কাভার করতে গিয়ে দুয়েকবার আমি সরকারি ফাইলও বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। যেটা আজকে বলছি, সে সময় হয়তো মনে হয়নি যে আমার এটা নেয়া ঠিক হয়েছে কি-না। আমি একবার দুটি ফাইল নিয়েছিলাম। ফাইল নিয়ে তা ফটোকপি করে আমি আবার ফেরত দিয়েছিলাম যথাযথ স্থানে। যে কূটনীতিক দিয়েছিলেন, তিনি অল্প কিছু দিন আগে মারা গেছেন। তিনি আমাকে এমন একটি রিপোর্টের জন্য সহযোগিতা করেছিলেন, যেটা এখন প্রকাশ করা ঠিক হবে না। ফরেন অফিস কাভার করার মধ্যে অন্যরকম একটা আনন্দ ছিল। পত্রিকা ছিল কম। ইত্তেফাক-এ একটা রিপোর্ট ছাপা হলে হুলুস্থুল হয়ে যেত, সেটা বুঝতাম। ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বিশেষ করে কূটনৈতিক রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে আমাকে যারপরনাই অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তখন ফরেন অফিস যে রিপোর্টিং টিম কাভার করতেন, সেই টিম খুবই অনুসন্ধানী ছিল। কূটনীতিকরা প্রশ্ন মোকাবিলা করতে কৌশলী থাকতেন। কারণ প্রায় সকলেই অভিজ্ঞ রিপোর্টারে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু আজকে আমি সেখানে ফারাক দেখি। যে ব্রিফিং এখন হয়, তার পুরোটাই কাগজে ছাপা হচ্ছে। রিপোর্টারের নিজস্ব মুন্সিয়ানা বিরল, তাঁরা ভেতর থেকে খবরটা বের করে আনতে পারেন না। একটা কথা বলতে হয়। আমাদের অনেক নেতা কিন্তু সীমান্তের সীমারেখা মানতে চান না। কিন্তু সব বুঝেও অনেক সময় রিপোর্টার হিসেবে অনভিপ্রেত খবর লিখতে হয়। একটা উদাহরণ দেই। জ্যোতি বসু ঢাকা সফরে এলেন। এয়ারপোর্টে তাঁকে বারংবার প্রশ্ন করা হলো, ভারতীয় রাজনীতি সম্পর্কে কিছু বলবেন কিনা। তিনি বলেন, আমি কলকাতা বিমানবন্দরে গিয়ে বলবো। কিন্তু এখানে আমি কোন কথা বলবো না। এখানে বলবো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে। আমাদের নেতারা যে যে-কোনও বিষয়ে মন্তব্য করে বসেন দেশে এবং বিদেশে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিদেশী মিশন প্রধানদের ডেকে নিজেদের ঘরের কথা বিস্তারিত খুলে বলার অপসংস্কৃতি ইতিমধ্যে পাকা আসন গেড়েছে। বিদেশে সফরে গিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি বিষোদগারও আর কোনও বিরল ঘটনা নয়। কোনও সন্দেহ নেই, জ্যোতি বসুর ওই বক্তব্য থেকে মনে করেছি যে, তিনিই সঠিক। এবং সেটাই করা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা প্রায়শ একটা বিপরীত চিত্র আমি লক্ষ্য করি। কখনও কখনও তা খুবই বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। ফরেন অফিস কাভার করার সময় কলকাতার যুগান্তর পত্রিকার সংবাদদাতাও ছিলাম। সেই সময় আমি দেখেছি কলকাতার সাংবাদিকরা কি ভাবছেন, আর ঢাকার সাংবাদিকরা কি ভাবছেন। তখন আসলে মিডিয়াতে কোন রিপোর্ট ছাপা হলে সঙ্গে সঙ্গে সেটার অ্যাকশন হতো। এখন প্রতিনিয়তই রিপোর্ট ছাপা হয়। ছাপা হলেও সেই রিপোর্টও তেমন হয় না। আর সরকার সেভাবে আমলেও নেন না। আর তখনকার কূটনীতিকরা, যারা দায়িত্ব পালন করতেন, তাঁরা যথেষ্ট দক্ষ ও কুশলী ছিলেন। তখন শ্রেষ্ঠ সময় ছিল বলে আমি মনে করি। এখন রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দেয়ার কারণে পেশাদার কূটনীতিকরা কোণঠাসা এবং যে কোন কারণে তাদের মধ্যে একটা বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। এই বিভাজনের কারণে কূটনৈতিক অর্জন ও ঔজ্জ্বল্য অনেক ম্লান। এটা বলা হয়তো অতিরঞ্জিত হবে না যে, বাংলাদেশের কূটনীতির স্বর্ণযুগ ছিল আশির দশক। বাংলাদেশের কূটনীতিকরা অনেক কিছুই অর্জনে সক্ষম। কিন্তু এখন যেভাবে নিয়োগ, পদোন্নতি বা কর্মস্থল নির্ধারণ হচ্ছে তা অনেক ক্ষেত্রেই অযথাযথ। যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের অনেকেই যেন শুধু কাউকে খুশি করার জন্য উদগ্রীব কিংবা উদ্দীপ্ত থাকেন। অবশ্য তাঁদেরকে সেই রকমই চালিত হতে ধারণা দেয়া হয়ে থাকে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কাভার করতে গিয়ে একবার পানি আলোচনায় যোগ দিতে জগজীবন রাম ঢাকায় এলেন। আলোচনা ভেঙে গেল। বিমানবন্দরে গিয়ে আবার ভারত সুর পাল্টালো। অর্থাৎ তখন ভারত ও বাংলাদেশের দুই দিকেই কূটনীতির একটা লড়াই হতো। এখন সিদ্ধান্ত হয় অন্য ভাবে, সে কারণে পেশাদারি মজাটা অনুপস্থিত। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কখনও উষ্ণ ছিল, কখনও হিমশীতল ছিল। শীতল সম্পর্কের কারণে অনেক সময় ভেঙে গেছে আলোচনা। আবার জোড়া লেগেছে। এটাই বোধহয় কূটনীতির বিউটি। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে মনে হয় সেটা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক থাকতেই হবে। এর কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু সেখানে গিভ অ্যান্ড টেক থাকতে হবে। ট্রানজিট, সীমান্ত, পানি, বাণিজ্য, সমুদ্র সীমা প্রভৃতি ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা একটি অব্যাহত বিষয়। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় পণ্য চলাচলে ১৯৭৪ সালে সিদ্ধান্ত হলেও তা কার্যকর হয়নি। (পরিশিষ্ট-১) অনেক কিছুই প্রায় স্থায়ীভাবে স্থির কিংবা চূড়ান্তভাবে ফয়সালা করা যায় না। সুতরাং গিভ অ্যান্ড টেক-এর সূত্র কখনই পরিত্যক্ত হওয়ার নয়। ভারত সেটা ভালোই জানে। কিছুদিন আগে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদাম্বরম কলকাতার এক বণিক সভায় তিস্তাচুক্তির অনুকূলে যুক্তি দিতে গিয়ে গিভ অ্যান্ড টেক কথাটির ওপর যথার্থই জোর দেন। আসলে এর কোনও বিকল্প নেই। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামার স্টোনের একটি উক্তি কূটনীতিতে দুনিয়া জুড়ে বহুল উচ্চারিত। তিনি বলেছিলেন, ‘জাতীয় সীমান্তের বাইরে স্থায়ী শত্র“ বা মিত্র বলে কিছু নেই। স্থায়ী আছে কেবল জাতীয় স্বার্থ।’ সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় বাংলাদেশকে এই নীতি অনুসরণ করতে গিয়েও পামার স্টোনকে কিন্তু মানতেই হবে। এই বই প্রকাশে অনেকেই আমাকে উৎসাহিত করেছেন। সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন। তবে খুব গুছিয়ে যে এটা প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে সেই দাবি করতে আমি অপারগ। কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় বিশেষ করে মধ্য আশির দশকের কিছু ঘটনাবলী এখানে গ্রন্থিত হলো। ১৯৮৫-১৯৮৭ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় আমার লেখা কূটনৈতিক দিনপঞ্জির অনেকটাই এখানে এসেছে। সার্ক, অ্যাঙ্গোলা, ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত লেখাগুলোও নেয়া হয়েছে বিচিত্রা থেকে। তবে সন্দেহাতীতভাবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যাঁর বক্তব্য ও অভিজ্ঞতার বয়ান এই বইয়ের প্রকাশনাকে অর্থপূর্ণ করেছে তিনি প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। তাঁর সাথে আমার অন্তরঙ্গ কথোপকথনের বিবরণ এই প্রথম আলোর মুখ দেখলো। বইয়ের এই অংশটি একান্তভাবেই এক্সক্লুসিভ, যার কোনও কোনও অংশ ইতিহাসের অপরিহার্য অনুষঙ্গ বলেই গণ্য হতে পারে। অন্তত কূটনীতির অন্দরমহল নামটি যে তাঁর কথোপকথন সার্থক করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর মৃত্যুর পরে আমি লিখেছিলাম, ‘স্যার, কিছুই যে বলে গেলেন না।’ তাতে লিখেছিলাম, বইটা কি প্রকাশিত হবে, নাকি অপ্রকাশিতই থেকে যাবে! দীর্ঘ ২৭ মাস একটানা পরিশ্রম করেছি। ইংরেজিতে ডিকটেশন নিয়েছি। বড় কঠিন ছিল তাঁর ডিকটেশন নেয়া। এমন সব ইংরেজি বলতেন যা হজম করতে আমাকে গলদঘর্ম হতে হতো। শুধু কি তাই? ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করে প্রতি সপ্তাহেই তাঁকে শোনাতে হতো। তখন তিনি প্রমিত বাংলায় কথা বলতেন কম। আমাদের মধ্যে কথা হতো সিলেটি ভাষায়। এক পর্যায়ে তিনি এতো ভালো বাংলা বলতে শুরু করলেন, তখন আমার নিজেরই ভয় হতো বাংলায় লিখতে ও কথা বলতে। প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার বই প্রকাশের পরিকল্পনা ছিল। ‘ইতিহাসের প্রান্তে’ প্রস্তাবিত নামকরণ ছিল। আশির দশকের শেষ ভাগে তাঁর বক্তব্য নোট নিতে শুরু করেছিলাম। জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভা থেকে তিনি পদত্যাগ করেই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর বাসায়। আমি একটু অবাকই হচ্ছিলাম কেন তিনি আমাকে বেছে নিলেন। ‘না’ বলার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ‘হ্যাঁ’ বলেই একদম নার্ভাস হয়ে গেলাম। কারণ আমার ভয় ছিলো, যদি ঠিকমতো কাজটি না করতে পারি তাহলে সম্পর্কের যে ইতি ঘটবে তাই নয়, আমার প্রতি তাঁর যে অগাধ বিশ্বাস তাতে ফাটল ধরবে। কত ঘটনা, কত স্মৃতি ২৭ মাসে অবলোকন করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। কখনও শিশুর মতো সরল, কখনও জেদি, কখনও বা পিতৃসুলভ শাসন। এই মানুষটি কঠোর দৃঢ়তার সঙ্গে কূটনৈতিক দুনিয়া কাঁপিয়েছেন এটা আমাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো। সময় গড়িয়েছে, পরিস্থিতি পাল্টেছে। তারপরও তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি ‘ইতিহাসের প্রান্তে’ বইটি প্রকাশের। এক বিকেলে ফোন বেজে উঠলো বাসায়। অপর প্রান্তে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব নজিবুর রহমান। ‘মতি ভাই, স্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বইটি প্রকাশ করবেন।’ আমি কিছুটা অবাক! হঠাৎ করে স্যার মত পাল্টালেন কেন? বললাম, ঠিক আছে। নজিব বললেন, হাক্কানী পাবলিশার্স রাজি হয়েছে। দু’দিন পর স্যার আবার আমাকে ফোন করলেন। ‘একবার আসেন কথা বলবো।’ বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছেন। পাশে তাঁর স্ত্রী মাহজাবিন চৌধুরীও। দু’জনের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল বড় চমৎকার। দু’জনই তারা ভালো বন্ধু ছিলেন। যাকে আমি মায়ের মতো শ্রদ্ধা করি। রান্না করা তার শখ। আরও বেশি শখ হচ্ছে কাউকে খাওয়ানো। খেতে খেতেই স্যার বললেন, ‘আমার সিদ্ধান্ত কি সঠিক হলো? আমি যে বই ছাপতে চাই।’ বললাম, স্যার আমি তো সাহস করে বলতে পারি না। এতদিন কষ্ট করলাম। অথচ বইটি প্রকাশিত হলো না। অনেকক্ষণ চিন্তা করলেন। বললেন, সবই তো ঠিক আছে। তবে বইয়ের সব চরিত্র যে এখনও জীবিত। সমাজে তারা প্রতিষ্ঠিত। আমি নিজেও একটি স্পর্শকাতর পদে বহাল। তাঁর লেখা বই নিয়ে হইচই হয়ে ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। হওয়ার মতো উপাদান অবশ্য রয়েছে বইয়ের পাতায়। সেই বই আর বেরোয়নি। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর মেয়ে নাসরিন বইটি প্রকাশের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁকে পাণ্ডুলিপি দেই। কিন্তু অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস! নাসরিন আমাদের কাঁদিয়ে অকালে চলে গেলেন। সে কারণে যতটুকু নোট উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তা এই বইয়ে ছাপা হলো। তাঁকে ঘিরে অনেক স্মৃতি জমে আছে। ১৯৮৪ সালে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যখন মারা যান, তখন সিদ্ধান্ত হয় তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। দেশে তখন সামরিক শাসন। এরশাদ প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন। আমার বড় ইচ্ছে মিসেস গান্ধীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান কাভার করার। সাহস পাচ্ছিলাম না কিভাবে বলবো। ড. খলিলকে আগে বললাম। খলিল তার অতিরিক্ত ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। খলিল শুনেই পরামর্শ দিলেন আপনি নিজেই সরাসরি স্যারকে বলেন। রুমে প্রবেশ করতেই দেখি স্যার লাল টেলিফোনে কথা বলছেন। অনুমান করতে পারি সম্ভবত সেনাশাসক জেনারেল এরশাদের সাথে কথা বলছিলেন। টেলিফোন রেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর? স্যার, আরও একবার বলছি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী যেন বলতে চান? স্যার, আমি দিল্লি যেতে চাই। ৩০ সেকেন্ড চিন্তা করেই বললেন, দেখি কী করা যায়। সব প্রস্তুতি তো শেষ হয়ে গেছে। সাথে সাথেই লাল টেলিফোনে জেনারেল এরশাদের সাথে কথা বললেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া সরকারি প্রতিনিধি দলে কাউকে নেয়ার সুযোগ নেই। তিনি জেনারেল এরশাদকে বললেন, স্যার একজন সাংবাদিক নিয়ে গেলে বোধ হয় ভালো হয়। এরশাদ রাজি হলেন। টেলিফোন রেখেই মহাপরিচালক, দক্ষিণ এশিয়াকে বললেন, আমাদের সাথে মতিউর রহমান চৌধুরীও যাবেন। আমি বাসা থেকে পাসপোর্ট নিয়ে দ্রুত হাজির হলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা দিল্লি গেলাম। দিল্লিতে তখন কারফিউ চলছে। বিচিত্রা-য় প্রকাশিত সেই অভিজ্ঞতার বিবরণ আছে বইয়ে। ইত্তেফাক-এর রেফারেন্স এডিটর নোমানুল হকের সৌজন্যে পাওয়া গেল সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত আগ্রাসন থেকে উদ্ভূত প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের ওপর ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো। মানবজমিন-এর সংশোধনী বিভাগের কর্মীরা যতনের সঙ্গে বানান ভুল শুধরে দিয়েছেন। তাদের ধন্যবাদ জানাই। অনুজপ্রতিম সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বই প্রকাশে সহযোগিতা দিয়েছেন। তাঁকেও ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানাই সূচীপত্রের প্রকাশক সাঈদ বারীকে, বই প্রকাশে তিনি সত্যিই নিষ্ঠাবান।
চ্যানেল আই ও বাংলাভিশনে টকশো উপস্থাপক মতিউর রহমান চৌধুরী সাংবাদিকতায় আসেন ৪১ বছর আগে। শুর" মফস্বল সাংবাদিকতা দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বাংলার বাণীতে স্টাফ রিপোর্টার। ১৯৭৪ সালে জাসদের ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও' কর্মসূচির খবর লিখতে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চাকরিচ্যুত। এরপর পূর্বদেশ-এ যোগদান । ৪টি পত্রিকা রেখে বাকি পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পর গেজেটেড সরকারি চাকরির অফার । প্রতিবাদে সরকারি চাকরিতে যোগদান থেকে বিরত। এক বছর বেকার থাকার পর দৈনিক দেশবাংলায় চিফ রিপোর্টার। সেখান থেকে দৈনিক সংবাদ-এ। ৮০ সালে 'মন্ত্রীরা ঘুষ খাবেন না, কুরআন শরীফ নিয়ে শপথ' শীর্ষক খবর লেখার কারণে কালো তালিকাভুক্ত। অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল। '৮২ সালের মার্চে দৈনিক ইত্তেফাক-এ । টানা ১০ বছর ইত্তেফাক-এর কূটনৈতিক রিপোর্টার। ‘দুর্নীতিপরায়ণদের উলাসের নৃত্য' শিরোনামে নিবন্ধ লেখার কারণে সাপ্তাহিক খবরের কাগজ-এর প্রকাশনা বাতিল। হুলিয়া জারি । খবরের কাগজ-এর পুনঃপ্রকাশ। এসব কারণে এরশাদ প্রশাসনের ১৭ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ । গাড়ি ভাঙচুর। এরশাদের পতনের আগে তিন মাস পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য করা । সৌদি আরবের হাফরল বাতেন সীমাড় থেকে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ কভার। '৯০-এর বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে প্রথম বাংলাদেশী সাংবাদিক। ফুটবলের জাদুকর মারাদোনার সাক্ষাৎকার গ্রহণ। ইত্তেফাক ছেড়ে আজকের কাগজ-এ যুগ্ম সম্পাদক। সম্পাদকের সাথে মতের অমিল হওয়ায় নীরবে পদত্যাগ। নিজের মালিকানায় দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা প্রকাশ। আর্থিক সঙ্কটের কারণে মালিকানা হাড়। বাংলাবাজার-এ সম্পাদক থাকাকালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে '৯৪ সালে কারাবরণ। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপ ফুটবল আসরে দ্বিতীয়বার উপস্থিতি। সম্পাদকের সাথে পরামর্শ ছাড়া সাতজন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করার প্রতিবাদে বাংলাবাজার থেকে পদত্যাগ । এরপর বাংলা ভাষায় প্রথম রঙিন ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন প্রতিষ্ঠা। '৯৫ সালে ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদদাতা হিসেবে যোগদান। বহুল আলোচিত ক্যাসেট কেলেংকারি মামলায় এক মাসের দ”। বিচারক লতিফুর রহমানের পদত্যাগ। এরশাদের ৬ মাসের জেল। বিশ্বকাপ ফুটবল আসরে পাঁচবার উপস্থিতি। সাংবাদিকতায় জাপান ও হংকং থেকে ফেলোশিপ। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির ওপর এক মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ। '৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করতে গিয়ে পাক বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার। তিনদিন হাত বেঁধে নির্যাতন। বাঙালি এক ক্যাপ্টেনের সহযোগিতায় মুক্ত। মৌলভীবাজার কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহ-সভাপতি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদে একাধিকবার দায়িত্ব পালন। ঢাকার মোহামেডান ক্লাবের সাথে দীর্ঘদিন জড়িত। লন্ডনের ডেইলি মেইল, সুরমা, কলকাতার যুগার, সংবাদ প্রতিদিন-এর সংবাদদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন। প্রথম প্রকাশিত বই ইনসাইড পলিটিক্স। দ্বিতীয় বই পলাশী থেকে বাগদাদ ।