সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রথম প্রকাশিত বইয়ের নাম ‘অন্বেষণ’, প্রকাশ ১৯৬৪-তে। অন্বেষণের ব্যাপারটা তাঁর পরবর্তী রচনাতেও প্রাধান্য পেয়েছে। ‘অবিরাম পথ খোঁজা’ বইয়ের প্রবন্ধগুলোতেও ঘটনাটি রয়েছে। এর প্রথম লেখাটির নাম ‘দর্শনের সুখানুসন্ধান’। সুখের জন্য পথ খোঁজার কোনো বিরাম নেই। প্রয়োজনের জগৎ থেকে মানুষ চেষ্টা করেছে মুক্তির জগতে পৌঁছাতে। মুক্তির সংজ্ঞা নানাভাবে দেওয়া সম্ভব; সেটা দেয়া হয়েছেও বৈকি; তবে মুক্তির আকাক্সক্ষার ভেতরকার মূল তাগিদটা যে সুখানুসন্ধান, তাতে বোধ করি সন্দেহ নেই। এই সুখ একটি অনুভূতির ব্যাপার; অনুভূতিটা ব্যক্তিরই; কিন্তু ব্যক্তির সুখ জড়িত থাকে এবং প্রভাবিত হয় সমষ্টির সুখের দ্বারা। ব্যক্তি ও সমষ্টি উভয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতর বাস করে। সুখের পথানুসন্ধানে তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের কার্যকর উপস্থিতি অত্যন্ত বাস্তবিক সত্য। কী করে সুখ আসবে সে নিয়ে অনুসন্ধানের বিরাম নেই। সময় বদলায়, সেজন্য সুখের পথ সম্পর্কে ধারণাও বদলে যায়। কিন্তু খোঁজার ব্যাপারে বিরতি থাকে না। দার্শনিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সমাজ-সংস্কারক, সবাই চেষ্টা করেন পথের বিষয়ে নিজেদের চিন্তা ও দুশ্চিন্তাকে অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে, এবং আশা রাখেন নিজেদের ভাবনাগুলোকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়িত করবার। এ কাজ সারা বিশ্বে ঘটেছে, ঘটেছে আমাদের দেশেও। এ বইয়ের প্রবন্ধগুলোতে ওই পথানুসন্ধানেরই কিছু নিদর্শন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পথানুসন্ধানে অতীত আছে, রয়েছে বর্তমানও। বর্তমান বিশ্বে যে অসুখ বিরাজমান তার কারণকে লেখক পতনকালীন পুঁজিবাদের দুঃশাসন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পুঁজিবাদ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বেড়ে উঠেছে। এখন চেষ্টা চলছে তাকে বিদায় করে দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের মানবিক সম্পর্ক স্থাপনের পথটাকে উন্মুক্ত করবার। লেখক এই চেষ্টার সমর্থক। প্রচেষ্টাগুলোর একেক দেশে একেক পথে এগুবে; কিন্তু এর একটা আন্তর্জাতিক চরিত্রও আছে। বইয়ের সবক’টি প্রবন্ধেই বিশ্বব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। সামন্তবাদের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, সেখানটাতেও ঔপনিবেশিক অবরোধের হস্তক্ষেপ ছিল; এবং রবীন্দ্রনাথের চিন্তাতে ভাববাদিতার সঙ্গে বস্তুজগৎসচেতনতার যে নিত্য টানাপোড়েন, সেটিও রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয়। এসব কথা বইটিতে এসেছে। আলোচ্য বিষয়গুলোকে কঠিন করে লেখা যায়; কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেটা করেন নি। তাঁর প্রবন্ধে গল্পবলার ধরন থাকে, সেটা এই লেখাগুলোতেও বিলক্ষণ রয়েছে। কিন্তু তাতে বক্তব্য হালকা হয় নি, বরং নিজস্ব গুরুত্ব বজায় রেখে হৃদয়গ্রাহী হয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (জন্ম. ১৯৩৬) পেশায় সাহিত্যের অধ্যাপক এবং অঙ্গীকারে লেখক। এই দুই সত্তার ভেতর হয়তো একটা দ্বন্দ্বও রয়েছে, তবে সেটা অবৈরী, মোটেই বৈরী স্বভাবের নয়। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, অবসরগ্রহণের পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রফেসর এমেরিটাস হিসাবে মনোনীত হয়েছেন। তিনি শিক্ষা লাভ করেছেন রাজশাহী, কলকাতা, ঢাকা এবং ইংল্যান্ডের লীডস ও লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখার কাজের পাশাপাশি তিনি ‘নতুন দিগন্ত’ নামে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। তার গ্ৰন্থসংখ্যা আশির কাছাকাছি। তার অকালপ্রয়াত স্ত্রী ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরীও লিখতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন।