ফ্ল্যাপে লিখা কথা ভ্রমণকাহিনির লেখকের দায়িত্ব হচ্ছে, তিনি কী দেখলেন তা পাঠককে জানানো। এই কাজটি কোনো ভ্রমণকাহিনির লেখক করতে পারেন বলে আমি মনে করি না। সৌন্দর্য কাগজে কলমে ব্যাখ্যা করা যায় না। সৌন্দর্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। ট্রয় নগরীর হেলেনের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে কবি হোমার অনেক পাতা খরচ করেন। কিন্তু সেই হেলেনকে পাঠক হিসেবে কি আমরা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি? কখনো না। যে দৃশ্য আগে কখনো দেখা হয় নি, মস্কিষ্ক সেই দৃশ্য দেখাতে পারে না। হেলেনকে আমরা কল্পনায় পরিচিত কোনো রূপবতীর আদলেই দেখব। বইটির সামারীঃ পায়ের তলায় সর্ষে অর্থ হলো ঘুরে বেড়ানো। যার পায়ের নিচে সর্ষে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভ্রমণকাহিনির সংকলনের নাম- ‘পায়ের তলায় সর্ষে’। তিনি খুব বেড়াতে পছন্দ করেন। বছরের ছয় মাসই থাকেন দেশের বাইরে। আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বের করেছি আমার পায়ের নিচে সর্ষে নেই। আমার ভালো লাগে অতি পরিচিত গণ্ডি এবং পরিবেশে নিজেকে আটকে রাখতে। কাজেই আমার পায়ের নিচে সর্ষে নেই, আছে খড়ম। বউলাওয়ালা খড়ম, যা পায়ে নিয়ে হাঁটা একটি কষ্টকর প্রক্রিয়া। আমার ভ্রমণকাহিনির নাম এই কারণেই ‘পায়ের তলায় খড়ম’। মূল কাহিনি হলো মেহের আফরোজ শাওন ছোটবেলায় ইস্তাম্বুলে কামাল আতাতুর্কের জন্মদিনে নাচতে গিয়েছিলেন সেখানে। জন্মদিন উপলক্ষে সারা বিশ্বের শিশুদের নিয়ে নাচ-গানের আয়োজন করে ঐ কর্তৃপক্ষ । সেই সুবাদে শাওন নির্বাচিত হন সেখানে তাকে থাকতে দেওয়া হলো তুর্কি পরিবারের সাথে ঐ পরিবারের মহিলাকে শাওন আন্নি বলে ডাকত। ঔ মরিয়ম নামের মহিলা শাওনকে অনেক আদর করত। এই ঘটনা জানার পরে হুমায়ূন মনস্থির করেন শাওনকে নিয়ে যাবেন সেখানে.....অবশেষে ২৫ বছর পর যান । যাওয়ার পরে দেখেন তার আন্নি আর বেঁছে নেই। লেখক ভ্রমণের কাহিনিটা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।