"রোবট" বইটির ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথাঃ “চেক ভাষা থেকে আসা রােবট শব্দটির অর্থ ‘অনৈচ্ছিক কর্মী বা সহজ কথায় ‘ক্রীতদাস'। রােসামের রােবটগুলাে ছিল সার্বজনীন। কারণ তাদের এমনভাবে নকশা করা হয়েছিল, যাতে মানুষের সব কাজই করতে পারে তারা। এই নাটকের কল্যাণে একসময় রােবট শব্দটির অর্থ দাঁড়িয়ে যায় ‘কৃত্রিম মানুষ’। আবার শব্দটি অটোমেটন শব্দটিকে পুরােপুরি হটিয়ে দেয়। এখন স্বচালিত কোনাে যন্ত্র বােঝাতে বিশ্বের প্রায় সব ভাষাতেই ‘রােবট’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।” (পৃষ্ঠা ৩২-৩৩) “ফরাসি সম্রাট চতুদর্শ লুইয়ের খেলনা সেনাবাহিনী ছিল। সম্রাটের ছেলের জন্য বানানাে এই খেলনা সেনাবাহিনী স্বয়ংক্রিয়ভাবে কুচকাওয়াজ করতে পারত | আবার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা এক ভারতীয় শাসক টিপু সুলতান কারিগর দিয়ে প্রায় ছয় ফুট লম্বা এক যান্ত্রিক বাঘ বানিয়ে নিয়েছিলেন। এতে ঘড়ির মতােই স্প্রিং ব্যবহার করা হয়েছিল। যান্ত্রিক বাঘটি লাফ দিয়ে এক খেলনা ব্রিটিশ সেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত।” (পৃষ্ঠা ২৩)
বইটি যেভাবে লেখাঃ রোবট বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম বইটি লেখেছেন আইজ্যাক আসিমভ এবং অনুবাদ করেছেন আবুল বাসার (সাংবাদিক)। আইজাক আসিমভ ১৯৪৮ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন, আর তিনি বোস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব্ মেডিসিন-এ প্রাণরসায়ন (বায়োকেমিস্ট্রি) বিষয়ে শিক্ষকতা করেন।কিন্তু তাই বলে তাঁর বই লেখার বিষয়ের মধ্যে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তিনি যেমন অনায়াসে লেখেন রসায়নশাস্ত্র নিয়ে, তেমনি অনায়াসে লেখেন গণিতশাস্ত্র নিয়ে, আবার তেমনি অনায়াসে রচনা করেন উপন্যাস। আবুল বাসার আবুল বাসার পেশায় সাংবাদিক। শুধু বিজ্ঞান নয়, শিশু-কিশোর লেখক ও অনুবাদক হিসেবে ইতিমধ্যেই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তুমুল জনপ্রিয় কিশোর আলোর সম্পাদনা বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। বর্তমানে দেশের প্রধান বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। রোবট নিয়ে চিন্তা করলেই সাধারণত ধাতু দিয়ে বানানো আর কিছুটা মানুষের মতো দেখতে এক অবয়বের ছবি আমাদের চোখে ভেষে ওঠে। এমনকি রোবটের কার্যকলাপ অনেকটা মানুষের মতো বলেও ধারণা অনেকের। সংক্ষেপে বলা যায়, আমাদের ধারণায় রোবট হচ্ছে, কোনো যান্ত্রিক মানব বা মানবী। বাস্তবে এমন কোনো রোবটের অস্তিত্ব না থাকলেও, আমাদের কল্পনাতে রোবটের চেহারা ওরকমই। আজ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে রোবট(robot) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। মানুষ যখন কাদামাটি দিয়ে নিজের মতো দেখতে ছোটখাটো মানুষের মূর্তি বানিয়েছিল, তখন থেকেই আসলে এ স্বপ্নের সূচনা। আবার এমনও হতে পারে সেকালে মানুষ ধারণা করতো যদি তারা ঠিক ঠিক মানুষের মতো দেখতে কোনো অবয়ব বা প্রতিমা বানাতে পারে, তাহলে সেগুলো জীবন্ত হয়ে যাবে। তাদের ধারণা অতিমানবিক ক্ষামতাসম্পন্ন এক দেবতা তাদের কাদামাটি দিয়ে বানিয়েছিলেন। পরে সেই দেবতা তাতে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালে ইলিয়াড মহাকাব্যে গ্রিকদের আগুনের দেবতা হিফাইসটোসের সম্পর্কে এক কাহিনী বর্ণিত আছে যে তিনি সোনা দিয়ে তরুণী মেয়েদের সৃষ্টি করতেন। ১৭৭১ সালে ইতালিয়ান বিজ্ঞানি লুইজি গ্যালভানি হঠাৎ চমকে ওঠার মতো একটি আবিষ্কার করে বসেছিলেন। মৃত ব্যাঙের পা-এ বৈদ্যুতিক সঞ্চালন করলে তা সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। তখন এইটিতে আবার জীবনের ফিরে এসেছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এই রকম ভাবে এই বইটিতে রোবটের আগেও কথা এবং এর সাথে মানুষের সম্পর্ক উল্লেখ্য করেছেন।
বিংশ শতকের অন্যতম সেরা লেখক আইজ্যাক আসিমভ সাহিত্যজগতের এক উজ্জ্বল নাম। তিনি ১৯২০ সালের ২ জানুয়ারি সোভিয়েত রাশিয়ার পেত্রোভিচি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে পরিবারের সাথে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ব্রুকলিনে শুরু করেন নতুন জীবন। ছোটবেলায়ই তাঁর বাবা তাকে লাগিয়ে দেন নিজেদের ক্যান্ডিশপে দোকানদারির কাজে। ছোট্ট আসিমভ পাঁচ বছর বয়সেই নিজে নিজে পড়তে শিখে যান। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি হাই স্কুল শেষ করেন এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি ১৯৩৯ সালে ব্যাচেলর অব সায়েন্স এবং পরবর্তীতে এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে তিনি বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি হলেও তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে নিয়মিত শিক্ষকতা করেননি। ১৯৫০ সালে বের হয় তাঁর প্রথম বই ‘পেবলস ইন দ্য স্কাই’, যা জয় করে নেয় সাধারণ পাঠকের মন। এরপর একের পর এক লেখা বের হতেই থাকে তাঁর। তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের মূল আধেয় হলো সায়েন্স ফিকশন, পপুলার সায়েন্স, রহস্য ইত্যাদি। সৃজনশীল মেধাসম্পন্ন এই লেখক ৫০০টিরও বেশি বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন। জনপ্রিয় লেখক আইজ্যাক আসিমভ এর বই সমূহ হলো, ‘আই,রোবট (১৯৫০)’, ‘ফাউন্ডেশন (১৯৪২)’, ‘দ্য এন্ড অব ইটারনিটি (১৯৫৫)’, ‘দ্য কেভস অব স্টিল (১৯৫৩)’, ফ্যান্টাস্টিক ভয়েজ (১৯৬৬)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত উপন্যাসই শুধু নয়, তুমুল জনপ্রিয় তাঁর ছোটগল্পগুলোও। আসিমভ এর রচনাগুলো থেকে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি বড় বাজেটের চলচ্চিত্র, যার মাঝে আছে ‘আই,রোবট (২০০৪)’, ‘বাইসেন্টেনিয়াল ম্যান (১৯৯৯)’ ইত্যাদি। বিশ্বজোড়া প্রকাশিত আইজ্যাক আসিমভ এর বই সমগ্র জয় করে নিয়েছে সায়েন্স ফিকশন পাঠকদের মন। তাঁর বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বের নামিদামী পরিচালক তৈরি করেছেন চলচ্চিত্র, বানিয়েছেন সিরিজ। ১৯৮৭ সালে ‘সায়েন্স ফিকশন রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা’ তাকে ‘গ্র্যান্ড মাস্টার অব সায়েন্স ফিকশন’ সম্মানে ভূষিত করে। তাঁর লেখা ‘ফাউন্ডেশন (ট্রিলজি)’ ১৯৬৬ সালে এনে দেয় ‘হুগো এওয়ার্ড’, ‘দ্য গডস দেমসেল্ভস’ এনে দেয় একইসাথে ‘হুগো’ ও ‘নেবুলা’ অ্যাওয়ার্ড। কল্পবিজ্ঞানের এই মহা কারিগর ১৯৯২ সালের ৬ এপ্রিল ব্রুকলিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।