‘মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব' বলে আদৌ কিছু হতে পারে কিনা এই নিয়ে এককালে অনেক তর্কাতর্কি হয়ে গেছে। ইমানুএল কান্ট বা গেওর্গ হেগেল-এর মতাে কার্ল মার্কস কি আদৌ আলাদা একটি দর্শনপ্রণালী খাড়া করতে চেয়েছিলেন ? এর উত্তর যদি হ্যা হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে: নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে মার্কস-এর মতামত কোথায় একসঙ্গে পাওয়া যাবে ? অবশ্যই এই প্রশ্নর একটিই উত্তর হতে পারে: না, তেমন কোনাে বই মার্কস লেখেন নি। আর, মার্কস কোনাে দর্শনপ্রণালী খাড়া করতে চেয়েছিলেন কিনা এই প্রশ্নর উত্তর যদি না হয়, তাহলে অনিবার্যভাবে প্রশ্ন উঠবে : তবে আর মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে ? প্রথম যৌবনে অর্থনীতির পাশাপাশি দর্শন নিয়েও মার্কস অবশ্য খানিক সন্ধান চালিয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সঙ্ ‘প্রথম আন্তর্জাতিক) প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাঁর প্রায় সমস্ত রচনাই অর্থনীতি-কেন্দ্রিক। তবে তারই মধ্যে এখানে-ওখানে, বিশেষ করে চিঠিপত্রে ছড়িয়ে আছে শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর ভাবনার নানা নিদর্শন। প্রসঙ্গ থেকে সেগুলিকে আলাদা করে এনে এমন বেশ কয়েকটি ছােটো-বড় উদ্ধৃতিসংগ্রহ সঙ্কলন করা হয়েছে। কিন্তু সকলে নিশ্চয়ই একমত হবেন : সেগুলির মধ্যে পথের নিশানা থাকলেও, পথের সুস্পষ্ট মানচিত্র নেই। বােধহয় সেই কারণেই উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গােড়ার মাকর্সবাদী তাত্ত্বিকরা আলাদা করে কোনাে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব গড়ে তুলতে চান নি। অন্যদিকে তাঁদের এই ধারণার উলটো রাস্তায় হেঁটেছিলেন গেওর্গ লুকাচ প্রমুখ হাতে-গােনা কয়েকজন দর্শনবিদ ও সাহিত্য-সমালােচক। নিজের নাটক ও তার প্রযােজনার সূত্রে বেল্ট ব্রেন্ট তেমনি পত্তন করেছিলেন নিজস্ব এক নন্দনতত্ত্বর। এঁদের কাজ থেকেও বােঝা যায় : মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বর একটি স্বকীয় পরিমার্গ (অ্যাপ্রােচ) আছে ; তার খেই ধরে অনেক দূর এগনাে যায়। গত পঞ্চাশ বছরে ‘সাহিত্যতত্ত্ব' নামে একটি বিষয়ের ব্যাপক চর্চা হয়েছে। আধুনিক ও আধুনিকোত্তর মতবাদগুলির সঙ্গে সঙ্গে ফ্রয়েডীয় ও মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বও তার আওতায় পড়েছে। সেই প্রসঙ্গে কেউ কেউ (যেমন, ফোক্কেমা ও কুনেই) একবচনের বদলে বহুবচনে ‘মার্কসবাদী সাহিত্যতত্ত্বাবলি' নামটি ব্যবহার করেছেন। সেটি একেবারে অকারণে নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব ও শিল্পকৃতির মূল্যায়নে সব মাকর্সবাদী সমালােচক একমত হন নি। শুধু সাহিত্যতত্ত্ব নয়, গােটা নন্দনতত্ত্বর ক্ষেত্রেও মতভেদ থাকা তাই খুবই স্বাভাবিক।