ভূমিকা শব্দের সঙ্গে বিভক্তি, অনুসর্গ, পরসঙ্গ বা কর্মপ্রবচনীয় যোগ করে পদ গঠন করতে হয়। যখন একটি পদকে অন্যপদে পরিবর্তন করা হয় তখন ঘটে পদান্তর বা পদ পরিবর্তন। সাধারণত বিশেষ্য পদকে বিশেষ্যে পরিণত করাকেই পদ পরিবর্তন বলা হয়।
সংস্কৃত বা বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত প্রত্যয় যোগে পদ পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। আপন, অন্বিত, আকুল, আতুর, উচিৎ, বৎসল, যুক্ত, শূন্য প্রভৃতি শব্দযোগে বিশেষ্যপদ বিশেষণ পদরূপে ব্যবহৃত হয় । লিঙ্গ কথাটির অর্থ হল নিদর্শন বা লক্ষণ। লক্ষণ দেখে যাবতীয় বিশেষ্য পদকে পুরুষ, স্ত্রী ও ক্লীব (যা পুরুষও নয় স্ত্রীও নয়)—এই তিন প্রকার লিঙ্গ পাওয়া যায়। এছাড়া উভলিঙ্গ বলে আর একরকম লিঙ্গ আছে, যা স্ত্রী-পুরুষ উভয়কেই বোঝায় যেমন শিশু, কেরানী, সন্তান, শত্রু, অন্ধ, পূর্বপুরুষ ইত্যাদি। লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে কেবলমাত্র প্রাণীবাচক শব্দেরই পুংলিঙ্গ বা স্ত্রীলিঙ্গ হয় আর অপ্রাণীবাচক, জড়পদার্থ, ক্রিয়া বা ভাব বোঝাতে ক্লীবলিঙ্গের ব্যবহার হয়। সংস্কৃতে পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ এবং ক্লীবলিঙ্গ এই তিন প্রকার লিঙ্গ আছে। শব্দবিচারে সংস্কৃত বাংলা ভাষার মত বাস্তববাদী নয়—বাংলায় লিঙ্গ বিচার করা হয় শব্দটির অর্থ বিচার করে আর সংস্কৃতে অর্থের ওপর জোর না দিয়ে শব্দের গঠনের ওপর নির্ভর করে লিঙ্গ বিচার করা হয়। কোন্ কৃৎপ্রত্যয় বা তদ্ধিত প্রত্যয় যোগে শব্দটি গঠিত বা কোন সমাসের আওতায় শব্দটির সৃষ্টি—এই সব প্রায়ই সংস্কৃত ভাষায় মুখ্য হয়ে ওঠে। কেবলমাত্র পুরুষ বোঝালেই কোন শব্দ যে পুংলিঙ্গ হবে বা স্ত্রী বোঝালেই যে কোন শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ হবে অথবা স্ত্রী-পুরুষ না বোঝালেই যে শব্দটি ক্লীবলিঙ্গ হবে এইরকম কোন সহজ নিয়ম আমরা সংস্কৃতে পাই না। ভোগ, যোগ, ত্যাগ, স্তব প্রভৃতি অপ্রাণীবাচক শব্দও সংস্কৃতে পুংলিঙ্গ। স্ত্রীবাচক দার, স্ত্রীলোক শব্দগুলি পুংলিঙ্গ। ‘সবিতা' শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ মনে হলেও সংস্কৃতে পুংলিঙ্গ। আবার স্ত্রীবাচক ‘কলত্র’ শব্দটি ক্লীবলিঙ্গ। অথচ নদী, লতা, গতি প্রভৃতি শব্দ সত্যিসত্যি স্ত্রীকে না বোঝালেও স্ত্রীলিঙ্গ। হিন্দীর ক্ষেত্রেও একথা বলা চলে। তাই সংস্কৃত ও হিন্দীর লিঙ্গ বিচার অত্যন্ত জটিল বিষয়। বিশেষ্যের পরিবর্তে সর্বনাম ব্যবহৃত হলে বিশেষ্যটি যে লিঙ্গ সর্বনামটিও সেই লিঙ্গ হবে। আবার আমি, তুমি, সে, তাহারা, তিনি, তোমরা প্রভৃতি সর্বনাম পদ স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্যবহৃত হয়। স্থান ও প্রয়োগ হিসেবে এগুলি কখনও স্ত্রীলিঙ্গ হয়ে থাকে। তবে লিঙ্গভেদে সর্বনামের রূপভেদ হয় না। ওটা, ওটা, সেটা, যাহা, তাহা প্রভৃতি সর্বনাম অপ্রাণীবাচক বস্তুর বা বিশেষ্যের পরিবর্তে বসে বলে এগুলি ক্লীবলিঙ্গ। তবে এটা, এইটি, ও, ওটি মাঝে মাঝে পুংলিঙ্গ বা স্ত্রীলিঙ্গ হয় পুংলিঙ্গ থেকে স্ত্রীলিঙ্গ করতে গেলে পুংলিঙ্গ শব্দটির পরে স্ত্রী-প্রত্যয় যোগ করে করা যায়। যেমন—কোকিল (পুংলিঙ্গ) কোকিল (আ-স্ত্রীপ্রত্যয়) = কোকিলা (স্ত্রীলিঙ্গ) রুদ্র (পুংলিঙ্গ) রুদ্র-আনা = রুদ্রাণী। যে সব সংস্কৃত শব্দ অবিকৃতভাবে সরাসরি বাংলায় এসেছে (তৎসমশব্দ) তাদের অনেকগুলিই নিত্য স্ত্রীলিঙ্গ পুংলিঙ্গ হয় না। যেমন—অঙ্গনা, আভা, ঋদ্ধি, ঊষা, উল্কা, অবনী, থামা, গতি, জিজ্ঞাসা, জ্যোৎস্না, নিশা, তারা, তারকা, তরী, তরণী, বনিতা, বিভা, বিদ্যা, বুদ্ধি, ভিক্ষা, ভক্তি, ভূ, ভার্যা, প্রতিমা, মেধা, মহিলা, মতি, মুক্তি, মেদিনী, রাত্রি, লতা, ললনা, লক্ষ্মী, শক্তি, শ্রী, বিংশতি হতে নবনবনবীত পর্যন্ত সংখ্যাবাচক শব্দ প্রভৃতি বহু সংস্কৃত শব্দ নিত্য স্ত্রীলিঙ্গ। অর্থাৎ এদের পুংলিঙ্গ শব্দ নেই । কৃতদার, কবিরাজ, কাপুরুষ, বিপত্নীক, মৃতদার প্রভৃতি শব্দগুলো নিত্য পুংলিঙ্গ শব্দ। এদের স্ত্রীলিঙ্গ হয় না। আ-প্রত্যয় যোগে অক-ভাগান্ত পুংলিঙ্গ শব্দের ‘অক’ স্থানে ইক’ করে শেষে ‘আ’-প্রত্যয়যোগে, জাতিবাচক ‘অ’-কারান্ত শব্দের শেষে ‘ঈ’-প্রত্যয় যোগে, ঋ-কারান্ত অৎ, বৎ, মত, ঈয়স, ইন, বিন, শালিন, অন্, বস্-ভাগান্ত, ঈ-প্রত্যয় যোগে, বহুব্রীহি সমাস নিষ্পন্ন পদের শেষাংশ অঙ্গবাচক হলে ‘আ’-‘ঈ’-প্রত্যয় যোগে, পত্নী অর্থে ‘আনী’ প্রত্যয় যোগে একাধিক অর্থে একাধিক স্ত্রী-প্রত্যয় যোগে পুংলিঙ্গ শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ করা যায়।