বয়স, আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক মাপ সব বিষয়েই আমাদের চেয়ে অনেক বড় অবনীদা বা কমরেড অবনী লাহিড়ীর আত্মকথন ও জিজ্ঞাসা নির্ভর এই গ্রন্থটির মুখবন্ধ লেখার দায়িত্ব আমার ওপরে বর্তানোর কারণটি আমাদের সকলের কাছেই মর্মান্তিক শোক ও দুঃখের। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামী ইতিহাসের বিশিষ্ট গবেষক অনুজপ্রতিম বন্ধু অধ্যাপক রণজিৎ দাশগুপ্তের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর কারণেই এই দায়িত্ব আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছে। ছাত্রজীবন থেকেই মার্কসবাদ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন রণজিৎ। তিনি তাঁর নিজের জীবন ও কর্মে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশীদারিত্ব, তত্ত্ব-চিন্তা এবং তত্ত্ব ও তথ্য নির্ভর গবেষণার কাজকে অসামান্য দক্ষতা ও নিষ্ঠায় মেশাতে পেরেছিলেন। নিজের জন্য নির্দিষ্ট এই দায়িত্ব পালনে তাঁর অকুতোভয় দায়বদ্ধতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাক্ষ্য এই গ্রন্থের প্রস্তুতি। ইতিহাস গবেষক হিসেবে রণজিতের বহুমুখি বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হল কঠিন শারীরিক বাধাকে তুচ্ছ করে গবেষণার টেবিলের নিরলস পরিশ্রমের পাশাপাশি সমসাময়িক সংগ্রামগুলির ময়দান থেকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সংগ্রহ এবং বর্তমান ও প্রাক্তন সংগ্রামীদের অভিজ্ঞতার বিবরণ সংগ্রহে নিষ্ঠা। এক বছরেরও বেশি সময়ব্যেপে বাংলার কৃষক আন্দোলনের উজ্জ্বলতম যুগের অন্যতম প্রধান কমিউনিস্ট নেতা ও সংগঠক অবনী লাহিড়ীর বক্তব্য ও কাহিনীকে প্রথমে অডিও ক্যাসেট ও পরে লিপিবদ্ধ করার যে কাজ রণজিৎ নিজের শারীরিক দুর্বলতা ও অন্য বহু অসমাপ্ত গবেষণার কাজকে সরিয়ে রেখে সম্পন্ন করে গেলেন তার তুলনা প্রকৃতই মেলা ভার। সমগ্র প্রকল্পটির ছত্রে ছত্রে রয়েছে রণজিতের অসামান্য নিষ্ঠা ও আলোচিত বিষয়বস্তুতে তাঁর গভীর জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসার পরিচয়। এ বিষয়ে আমার ভূমিকা ছিল নেহাতই সীমিত অনুঘটকের। কাজটির প্রয়োজনীয়তা বুঝে রণজিতের মতো যোগ্যতাসম্পন্ন গবেষককে এ কাজে উৎসাহ যোগানোটুকুতেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। অন্য বহু কাজের মধ্যে অল্প সময়ে একাজ শেষ করার শারীরিক-মানসিক পরিশ্রম রণজিতের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কতটা দুর্বল করে ফেলেছিল এবং সেটা তাঁর অন্তিম রোগাক্রমণে কি ভূমিকা পালন করেছে সে বিলাপ এখন অর্থহীন হলেও যাঁরা জানেন তাদের মনে না এসে পারে না।