বাংলা নাট্যশিল্পের আসরে নাট্যভাস্কর ড. মুকিদ চৌধুরীর স্বতন্ত্রচিহ্নিত। তার বিভিন্ন সময়ে লেখা নানা স্বাদের পাঁচটি নাট্যোপন্যাস নিয়ে ‘ইত্যাদি' প্রকাশনার এই নতুন সংযোজন, নাট্যভাস্কর ড. মুকিদ চৌধুরীর ‘পঞ্চবেদ’। এই ‘পঞ্চবেদ’-এ রয়েছে লোকগাঁথায় ‘চম্পাবতী’, মুক্তিযুদ্ধে ‘তারকাঁটার ভাঁজে’, নারী-মুক্তিতে ‘বন্ধ্যা’, ইতিহাস আশ্রয়ে ‘যোদ্ধা’ ও মহাভারতের অলিখিত অধ্যায় ‘কর্ণপুরাণ’। ‘চম্পাবতী’: গৌড়ের এক সুন্দর অঞ্চল ছিল চন্দ্রদ্বীপ। প্রাচীন লোকগাঁথায় আর ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ এই জনপথ, যা একসময় ছিল গৌড়েশ্বরের অধীনে। সেসময় চন্দ্রদ্বীপে ছিলেন তিনজন জমিদার, তারা অবশ্য গৌড়ের অভিজাতশ্রেণি হিসেবে বিবেচিত হতেন। জমিদার প্রিয়নাথ, রামচন্দ্র রায় ও শাহ সিকান্দার ধন-সম্পত্তি আর ক্ষমতা কোনও অংশেই গৌড়েশ্বরের চেয়ে কম ছিল না। জমিদার প্রিয়নাথ ছিলেন শান্তিপ্রিয় ও সুদর্শন যুবক, তিনি চান রামচন্দ্র রায়ের কন্যা চম্পাবতীকে বিয়ে করতে। অন্যদিকে, রামচন্দ্র রায় ও শাহ সিকান্দার ছিলেন অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ। তারা সহজেই একের সঙ্গে অপর বিবাদে ও বিদ্বেষে ফেটে পড়েন, তাই হয়তো-বা তারা দীর্ঘদিনের এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে লিপ্ত হন। একসময় এই দুই পরিবারের সদস্য গাজী ও চম্পাবতী, ধর্মের বিভেদ ভুলে, একে অপরকে ভালোবাসেন, আর প্রিয়নাথ, সমধর্মের লোক হলেও হন বঞ্চিত। এই হিন্দু-মুসলমান প্রেম-কাহিনী নিয়েই রচিত হয়েছে ‘চম্পাবতী’। ‘তারকাঁটার ভাঁজে’: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা যে অংশ নেন এবং পাক-সশস্ত্র-বাহিনীর অত্যাচারের সম্মুখীন হন তা সমগ্র বিশ্ববাসীর অজানা নয়। নারী যে পুরুষের মতোই সাহসী ও যোদ্ধা এরকম একজন বীরাঙ্গনার গৌরবময় দিক নিয়ে রচনা করা হয়েছে ‘তারকাঁটার ভাঁজে’। এই নারীযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সহযোদ্ধা ছিলেন দুজন পুরুষ। তাদের সহযোগিতায়ই তিনি পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্রভাবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন, নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের সঙ্গে সৈন্য পরিচালনা করেন, পরিশেষে তিনি দেশকে স্বাধীন করে রণক্ষেত্র থেকে অবসর নেন। ‘বন্ধ্যা’: অস্পৃশ্য, অনাদৃত, অবহেলিত এক সন্তানহীন একজন নারীকে তার মনুষ্যত্বের সম্মানে উন্নীত করতেই রচিত হয়েছে এই নাটকটি। এই সন্তানহীন নারীর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রকাশ ঘটেছে এতে। ‘যোদ্ধা’: মানুষের ভিতরের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিভাবে রহস্যময়ী নারীরূপে তাকে কুমন্ত্রণা দেয়, কিভাবে মানুষের ভিতরের গোপন বাসনাকে কালসাপের মতো উন্মাদ করে তুলে, স্বাভাবিক নীতিবোধকে অন্ধকারে ঢেকে দেয় এবং হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সমস্ত বিবেক বিসর্জন দিয়ে আপন মানুষকে, যে তার সবচেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষিত তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যা হতে পারে আর্থিকভাবে অথবা দৈহিকভাবে। তারপর নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার প্রয়াসে একের-পর-এক বিধ্বংসী ও অমানসিক পৈশাচিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়। অবশেষে নৃশংস হত্যা ও পাপকর্মের পরিণাম স্বরূপ এই মানুষ নামের জীবটিরও মত্যু ঘটে শোচনীয়ভাবে। এই পাপাচার ও তার পরিণামের এক মর্মবিদারী বিষয়ই ‘যোদ্ধা’ নাটকের মূল উপজীব্য। একজন মানুষের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে যে-জীবন স্থাপিত হয় তা অবশেষে তাকেই নিক্ষেপ করে অন্ধকার মৃত্যুকূপে। ‘কর্ণপুরাণ’: কর্ণ মহাভারতের একটি ক্ষুদ্র অংশ নয়, বিশাল অংশ নিয়েই তার প্রভাব; তবে কর্ণ-আখ্যানের মর্মগাথার যে অন্তর্গত সত্য ও শক্তি তা মহাভারতের ব্যাপকতাকেও ছাড়িয়ে যায়। মহাভারত পাঠকালে কর্ণকে মনে হয় তিনি যেন আমাদের মানুষ, অনার্য বাঙালি। তাই তাকে দেখানো হয়েছে অন্যভাবে, কৌরব ও পাণ্ডব রাজপুত্রের চেয়েও কুশলী বীররূপে। তাই এই নাটকে সর্বোতভাবে সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। মহাভারতের আর্য-আখ্যান জুড়ে আছে, প্রকটভাবে, হিংসা-দ্বেষ-ক্রোধ-প্রতিহিংসা-যুদ্ধ এবং কুটিল-জটিল রাজনীতি আর এসব প্রকাশ করতেই অনার্য বীরদের করা হয়েছে অসহায়, কিন্তু ‘কর্ণপুরাণ’-এর কর্ণ অসহায় নন, বরং বীর-বাঙালি।