মস্কৌ থেকে লেখা একটি পত্র-প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সংখ্যাধিক একদল অখ্যাত লোকের কথা বলেছিলেন, মানুষের সভ্যতায় যাদের মানুষ হওয়ার সময় নেই, দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। তারা সবচেয়ে কম খেয়ে, কম পরে কম শিখে বাকি সকলের পরিচর্যা করে। তাদের অবহেলিত অকিঞ্চন জীবন সম্পর্কে কবি একটি নিষ্ঠুর অথচ সত্যভাষণ ঘোষণা করেন, ‘সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান।' সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও এই কথাগুলি আমার মনে পড়ল, বর্তমানে অতি জনপ্রিয় লোককলা যাত্রার কথা ভেবে। যদিও চিৎপুরের যাত্রাগান আজ তার বহুব্যাপ্ত পরিধি নিয়ে বিপুল সংখ্যক জনচিত্ত জয় করতে সক্ষম হয়েছে। কলকাতার দৈনিক ও সাপ্তাহিক কাগজে পাতাভর্তি বিজ্ঞাপন ও যাত্রাপালার সমালোচনা, সোনার পাথর বাটির মতো বেতারে, রেকর্ডে ও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মঞ্চে পালা অভিনয়, বছর বছর যাত্রা উৎসব ছাড়াও, দেশে বিদেশে যাত্রাভিনেতাকে পুরস্কার ও সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে পালাভিনয়ের নতুন যুগ প্রবর্তিত হয়েছে। এখন সমগোত্রীয় অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের সঙ্গে যাত্রাপালাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। বিষয় বৈচিত্র্য, আঙ্গিক পরিবর্তন, নতুন কলাকৌশল, আলোক সম্পাত প্রভৃতির সঙ্গে চলচ্চিত্র ও মঞ্চের খ্যাতিমান অভিনেতারাও আজ যাত্রার প্রচার-পত্রিকা আলো করে যাত্রাকে একটি নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসী, এবং আমাদের সভ্য শিক্ষিত নাগরিক সমাজও ‘একদা-হীন-যাত্রাওলাদের' বহু পরিশ্রম এবং বহু অসম্মানের কঠিন হাতে বয়ে নিয়ে আসা গৌরবান্বিত পতাকাটি তুলে ধরবার জন্য ব্যস্ত।