বাংলা ভাষার জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারের রক্তে রাঙা ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ওই দিনটিকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয় সারা বিশ্বে। অথচ, ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস— স্বাধীন ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্যে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন একাধিক নারীসহ অনেক বেশি বাঙালি। তার খবর কে রাখে? হ্যাঁ, আমরা অসমের কথা বলছি। বহু ভাষাভাষী মানুষের প্রদেশ অসম স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাঙালির বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। অসমিয়া জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের উন্নতিতে বাঙালিরাই প্রধান অন্তরায়— এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে শুরু হয় ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। শুরু হয় অসমবাসী বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস, নির্যাতনের ইতিহাস। সমকালীন বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্র সাক্ষী থেকেছে অগ্নিগর্ভ এই সময়ের। অথচ একুশ শতকের বাঙালি ইতিহাসের এই কলঙ্কিত অধ্যায় সম্পর্কে আশ্চর্য রকমের নিশ্চুপ। এই নীরবতার একটি কারণ অবশ্যই বাঙালির স্বভাবসিদ্ধ বিস্মৃতি, কিন্তু আর একটি কারণও তুচ্ছ নয় । বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য সেদিন অসমবাসী বাঙালিরা যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সচেতনভাবে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন। আর তাই তার ঐতিহাসিক সাক্ষ্যগুলিও যাতে ধীরে ধীরে দেশবাসীর স্মৃতির বাইরে চলে যায়, সেই প্রচেষ্টায় যত্নবান ছিলেন তাঁরা। অথচ এ সময়ের ইতিহাস আসলে অসমবাসী বাঙালি ও বাঙালি উদ্বাস্তুদের ভিটেমাটি হারানোর ইতিহাস, নারী নির্যাতনের ইতিহাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস। ড. সুকুমার বিশ্বাস তাঁর পরিশ্রমী গবেষণায় সমসাময়িক সংবাদপত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অসমে ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি-প্রসঙ্গের এক কালানুক্রমিক প্রামাণ্য দলিল তৈরি করেছেন। এই গ্রন্থ ইতিহাসের নিশ্চুপ সেই অধ্যায় সম্পর্কে একইসঙ্গে সরব ও সোচ্চার।
ড. সুকুমার বিশ্বাসের জন্ম ১৯৪৫ সালে। ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পােস্ট ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। কিন্তু এখানেই গবেষকদের গবেষক’ নামে খ্যাত ড. বিশ্বাসের গবেষণাকার্য শেষ হয় না। পরবর্তীকালে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে ইনস্টিটিউট অব ডেভলপিং ইকনমিজ-এ ফেলাে হিসেবে এবং হিরােশিমা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। এ ছাড়া টোকিয়াে ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ-এ ওরাল হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীতে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘ তিরিশ বছর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তন্নিষ্ঠ গবেষণার পাশাপাশি উভয় বাংলায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রামাণ্য ইতিহাস রচনাও তার অন্যতম কৃতিত্ব। ড. বিশ্বাসের উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি হল : বাংলাদেশের নাট্যচর্চা ও নাটকের ধারা ১৯৪৭-১৯৭১, অসহযােগ আন্দোলন '৭১ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী, একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সিপিআইএম ও গণশক্তি, Communal Riots in Bangladesh and West Bengal 1947-1964, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আগরতলা ত্রিপুরা : দলিলপত্র, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১: নারী, প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারীর বিবরণ।