কিন্নর রায়ের ছোট গল্প লেখার বয়স প্রায় তিরিশ হতে চলল। এই তিন দশকে স্বাভাবিকভাবে বাঁক বদল করেছেন লেখক। নিজেকে ভেঙে চুরে, পেরতে তিনি আজও সমানভাবে সৃষ্টিশীল। শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার জাবর-কাটা নয়, বরং চোখে দেখা বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনা, স্বপ্ন আর শিল্পের বাস্তবিকতাকে মিশিয়ে দিয়ে এই লেখক তাঁর আখ্যানমালাকে করে তুলতে চেয়েছেন কুহকী এক জাদু-আয়না। মানুষ কেন জন্মায়, কেন বাঁচে, কেনই বা বাচতে বাঁচতে বাঁচতে এক সময় ক্লান্ত, অবসাদ-আচ্ছন্ন, বিষয়, স্থবির হয়ে হয়ত আপন বাসনাতে, নিভৃতে, একান্ত ইচ্ছায় আহ্বান করতে থাকে নিশ্চিন্ত মৃত্যুকে, তারপর সেখানেই না থেমে থেকে আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখে | পুনর্জীবনের, এই যে জীবন-ধাঁধা— কেন জন্ম, কী কারণেই বা একই জনমে জন্ম, জন্মান্তর— তা নিয়ে যে দার্শনিক জিজ্ঞাসা, তারও শাশ্বত উচ্চারণ আমরা উঠে আসতে দেখলাম এই লেখকের মায়া-কলমে। জীবনে কিছুই তো শাশ্বত নয়, অনিত্য-বহতা, চলমান জীবনের এই | শিল্প-ছবি তুলে আনলেন তিনি। খণ্ডসময়, মহাসময়, সমাজ, মানুষ, রাজনীতি, ধর্মনীতির সঙ্গে সঙ্গে মানব সম্পর্কের বিচিত্র মুখকেও তুলে এনেছেন আখ্যানকার। ঘটিত বাস্তবের সঙ্গে শিল্পের | বাস্তব মিশেছে এক আশ্চর্য ছন্দময়তায়। জীবন, জীবনযাপন, জীবনের বিচিত্র ঘাত-প্রতিঘাত, যাদের কথা প্রায় কেউই জানেন না, সেই সব তথাকথিত ‘প্রান্তিক’-দের নিজস্ব যন্ত্রণারেখা, বাঁচার আনন্দ উঠে এল এইসব আখ্যানমঞ্জরীতে।
Kinnar Ray-এর জন্ম ১৯৫৩ সালের ৬ নভেম্বর কমলকাতার চেতলায়, পিসিমার বাড়িতে। বাবা অমরনাথ রায় মা গায়ত্রী রায়-দুজনেই প্রয়াত। এই আখ্যানকারের শৈশব, বালকবেলা, কৈশোর আর প্রথম যৌবন কেটেছে চেতলা, শিবপুর আর হাওড়া জেলার বালিতে। বিপুল দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে স্কুলে পড়ার সময়েই সত্তরের উত্তাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন কিন্নর। তখন দু'চোখে সমাজ বদলের স্বপ্ন। সেই সব টালমাটাল ঝোড়ো দিনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মাশুল হিসেবে বার বার জেলে যেতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৭-এ জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর পরই জেল থেকে বেরিয়ে জীবিকার সন্ধানে বহু ধরনের কাজ করেছেন। বিচিত্র সেই সব পেশা। তার মধ্যেই খবরের কাগজে যাওয়া-আসা শুরু| লেখালেখির শুরু সত্তর দশকের প্রায় শেষ লগ্ন থেকে। লিখে থাকেন, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য নানা ধরনের বিচিত্র লেখ তার খবরের কাগজের হিচর ও উত্তর সম্পাদকীয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় নব্বই। পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মান। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার, সোপান পুরস্কার, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ও আখিল ভারতীয় মারোয়াড়ি সম্মেলন’-এর দেওয়া ভরত-ব্যাস পুরস্কার সহ অন্যান্য বহু পুরস্কার ও সম্মান। ২০০৭ -এ ‘মৃত্যুকুসুম’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ করে তাঁকে আবিষ্কার করাও তাঁর কাছে এক ব্রতই। পাখিদের জীবনযাত্রা, ওড়াউড়ি, খাদ্য সংগ্রহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসেন। যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চোখরাঙানি, চাপ তাঁর না-পসন্দ। ‘চলতি হাওয়ার পন্থী' তিনি কখনও হতে চাননি। তাঁর জীবন যাপন, লেখালেখি, কথাবার্তা বলে যায় সেই কথাই।