মহাশ্বেতা দেবী রচিত সাহিত্যের পরিমাণ ও বিষয়বৈচিত্র্য বিস্ময়কর। চারটি উপন্যাস, এগারোটি গল্প, একটি করে প্রবন্ধ, নাটক, স্মৃতিকথা ; দুটি করে ভ্রমণ-কাহিনি, সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিতর্পণে সেই ব্যাপ্তি, প্রগাঢ়তা, অবিচারের ‘বিরুদ্ধে নিরঞ্জন শুভ ও সূর্যসম ক্রোধ’, ‘সাহিত্যের দাবি আর জীবনের দাবি'র সেই যুগলবন্দি, তাঁর ‘যন্ত্রণার- বেদনার-প্রশ্নের-আর্তির', তাঁর জীবনভর বিরামহীন ‘পরিশ্রম, অন্বেষা, নিয়ত শেখা', সর্বোপরি এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ‘এই নিরন্তর পথ হাঁটার' দুষ্কর জীবনসাধনার পরিচয় কতখানি অনুগামিতায় পরিস্ফুট করা গেল, সে-বিষয়ে আমরা পুরোপুরি সংশয়মুক্ত নই। তবে, ভরসা সেই চিরচেনা বরাভয়-বাক্য-বিন্দুতে সিন্ধুর স্বাদ। সুদীর্ঘ ৮২ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘মহাশ্বেতা : তথ্যপঞ্জি' এই গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে আমরা মনে করি । মহাশ্বেতা-রচনার আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু পাঠক ও গবেষকদের সতত জিজ্ঞাসা কৌতূহল সচরাচর যে-সব বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত, এখানে তার সন্ধান পাওয়া যাবে। এই অংশে রয়েছে : মহাশ্বেতা দেবী ও তাঁর সাহিত্য বিষয়ে এ-যাবৎ প্রকাশিত ১৪টি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ও ১১টি লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যার তালিকা । ৮১টি বাংলা ও ইংরেজি সাক্ষাৎকার । তাঁর রচনা-বিষয়ে ২৫৬টি বাংলা ও ৮২টি ইংরেজি আলোচনা-সমালোচনা-প্রতিবেদন। মহাশ্বেতা দেবীর প্রকাশিত বাংলা গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ তালিকা । অন্য ভাষায় অনূদিত উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ- গ্রন্থের তালিকা। প্রথম প্রকাশ ও পুনর্মুদ্রণের স্থান-কাল সহ ৩৫০টি গল্পের তালিকা এবং এ-যাবৎ প্রাপ্ত ৫৫টি পুরস্কার ও সম্মাননা-সহ সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি । সব মিলিয়ে এই গ্রন্থ পাঠকের পছন্দ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস ।
১৪ জানুয়ারি, ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা শহরে মহাশ্বেতা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী।তাঁর বাবা মণীষ ঘটক ছিলেন কল্লোল সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মনামে লিখতেন। মণীষ ঘটকের ভাই ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। মহাশ্বেতা দেবীর মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন লেখক ও সমাজকর্মী। তাঁর ভাইয়েরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ছিলেন। যেমন, শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর এবং শচীন চৌধুরী ছিলেন দি ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মহাশ্বেতা দেবীর বিদ্যালয়-শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঢাকা শহরেই। ভারত বিভাজনের পর তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠভবনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল হাজার চুরাশির মা, রুদালি, মার্ডারারের মা, বেহুলার বারোমাস্যা, দিয়া ও মেয়ে নামতা, স্বপ্ন দেখার অধিকার, প্রস্থানপর্ব, ব্যাধখণ্ড, অরণ্যের অধিকার ইত্যাদি। মহাশ্বেতা দেবী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ় রাজ্যের আদিবাসী উপজাতিগুলির (বিশেষত লোধা ও শবর উপজাতি) অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছিলেন। তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (বাংলায়), জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার সহ একাধিক সাহিত্য পুরস্কার এবং ভারতের চতুর্থ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান যথাক্রমে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ লাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেছিল। তিনি ২৮ জুলাই, ২০১৬ মৃত্যুবরণ করেন।