রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার ইতিহাসে বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২) যেমন এক গুরুত্বপূর্ণ কবি-ব্যক্তিত্ব তেমনি বাংলা গদ্যের প্রকর্ষণার ..ইতিহাসে বিষ্ণু দে অনস্বীকার্য। তাঁর কবিতার ভুবনে যেমন অনুশীলিত রসজ্ঞান, পরিশ্রমী গঠন, পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা, দেশজ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্র সংলক্ষ্য, তেমনি তাঁর প্রবন্ধেও রয়েছে আধুনিক সময়-সংকট, বৈশ্বিক চেতনা, স্বকাল ও স্বদেশের চেতনা। তাঁর প্রবন্ধে প্রতিফলিত হয় মননের আর এক উন্মোচন, জীবনচেতনা ও কালগত পরিক্রমা। তাঁর অন্বেষণ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত ও পরিপুষ্ট। তাঁর প্রবন্ধে পরিশুদ্ধ নান্দনিক বোধ, সংবেদনশীলতা, ঋদ্ধ মননচিন্তা, পারিপার্শ্বিক জীবনচিতার আচ্ছেদ্যবোধ, সচেতন দায়বদ্ধতা তাঁকে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে স্মরণীয় প্রতিভারূপে চিহ্নিত করেছে। তাঁর গদ্য মননস্পর্শী, সহজতর, বাবিন্যাসের দ্যুতিতে আকর্ষণীয়। তাঁর প্রবন্ধ গড়ে ওঠে বিশ্বসাহিত্যশিল্পের বিভিন্ন প্রতিভার বিশ্লেষণে; আবার স্বদেশের সাহিত্য-শিল্পের . আলোচনায় তিনি আর এক জগতের সন্ধান দেন যা প্রথানুগত আলোচনা বা বিশ্লেষণ নয়। বিষ্ণু দে-র গদ্য গড়ে ওঠে সংক্ষিপ্ত বাক্যবন্দে, দীর্ঘ বাক্যের গঠনবেদ্যতায় দেখি সামাজিক বাস্তবতার চিন্তা-চেতনার দীপ্ত প্রকাশ। তাঁর প্রবন্ধ স্বদেশ-এষণার মানসে, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদে, লোকঐতিহ্যে, বিশ্বসাহিত্যে শিল্প-সংস্কৃতিতে অভিন্নাত বলে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের বিকাশমান ধারার এক অনন্য সম্পদ।
বিষ্ণু দে (১৮ জুলাই ১৯০৯ - ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২) একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি লেখক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক। তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ বইটির জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ লাভ করেন। বিষ্ণু দের পিতা অবিনাশ চন্দ্র দে ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। বিষ্ণু দে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট এবং সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল-এ পড়াশোনা করেন । ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর বঙ্গবাসী কলেজে আইএ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে সাম্মানিক ইংরাজি বিষয়ে স্নাতক হন সেন্ট পল্স কলেজ থেকে। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম এ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি রিপন কলেজে (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) যোগদান করেন শিক্ষক হিসেবে। এরপর তিনি ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ান। এরপর তিনি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজেও অধ্যাপনার কাজ করেছেন। ১৯২৩ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে যে সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কবি বিষ্ণু দে তার একজন দিশারী। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় তার অবদান বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে। ১৯৩০ সালে কল্লোলের প্রকাশনা বন্ধ হলে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় পত্রিকায় যোগদান করেন এবং সেখানে একজন সম্পাদক হিসাবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেন। তিনি নিরুক্তা নামের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন। তার কবিতার মূল উপজীব্য হল মানুষ, তার সংগ্রাম ও রাজনীতি, সেখানে সমকালীন জীবনের, দেশ ও কালের, রাজনীতি ও সমাজের প্রতিধ্বনি। প্রথমদিকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দুই সংস্কৃতিরই প্রভাব পড়েছে তার লেখায়। দেশীয় পুরাণ, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পসাহিত্য থেকে ইউরোপীয় ক্লাসিক ও আধুনিক শিল্প সাহিত্যের প্রভাব এবং পরে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, তেভাগা-আন্দোলন ইত্যাদি থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরের ঘটনাবহুল জীবন ও আন্দোলন তাঁর কবিতায় সরাসরি ছায়া ফেলেছে। তিনি বামপন্থী দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এছাড়া কবি টি এস এলিয়টের রচনাশৈলী এবং ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছড়ানো এই জীবন নামে একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন। এছাড়াও অনুবাদের কাজ করেছেন। তার অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে আছে এলিয়ট, পল অ্যালুয়ার ও মাও-ৎ-সেতুঙের কবিতা। বিষ্ণু দে'র সঙ্গে শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ শাহেদ সোহরাওয়ার্দী ও শিল্পী যামিনী রায়ের বন্ধুত্ব ছিল। তিনি অঙ্কন শিল্পের উপর কিছু বই রচনা করেন, যেমন আর্ট অফ যামিনী রয়(সহযোগে) দ্য পেন্টিংস অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর (১৯৫৮) এবং ইন্ডিয়া অ্যান্ড মডার্ন আর্ট (১৯৫৯)। তিনি ক্যালকাটা গ্রুপ সেন্টার, সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন, প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ, ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েসন, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছবিও আঁকতেন। সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, নেহরু স্মৃতি পুরস্কার, এবং জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এছাড়া তিনি সোভিয়েত ল্যান্ড অ্যাওয়ার্ড পান।