শক্তি চট্টোপাধ্যায়-এর গদ্যসংগ্রহ ৪র্থ খন্ড (কিছু অংশ)
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য তাঁর পদ্যেরই সাঁকো ‘কৃত্তিবাস' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বাংলা কাব্যজগতে যে কয়েকজন তরুণ কবি নতুন উদ্যমে, নতুন ভাবে-ভাবনায় এমনকি এক ভিন্ন প্রকৃতির জটিল জীবনযাপনে হৈ-চৈ বাঁধিয়ে তদানীন্তন পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, শক্তি চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৩-৯৫) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যদিও আবির্ভাব মুহূর্তে শক্তি ‘কৃত্তিবাস' (প্রথম প্রকাশ শ্রাবণ ১৩৬০ ) পত্রিকার সঙ্গে ছিলেন না, কিন্তু অচিরকালের মধ্যে নিজস্ব স্বভাবে কৃত্তিবাসের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র শক্তি, কবিতার চেয়ে গদ্য রচনায় অধিক আগ্রহী, যেজন্য তরুণ কবিদের মুখপত্র ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সংযোগ বিলম্বিত হয়েছিল। ‘কৃত্তিবাস' পত্রিকার ষষ্ঠ সংকলনে (১৩৬২) স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ছদ্মনামে, বরেন গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘বর্গী এলো দেশে’ শীর্ষক একটি ছড়ার বই সমালোচনা করেন। সেই সমালোচনার সূত্রেই এক বন্ধুর সঙ্গে বিতর্কের ফলে তিনি চ্যালেঞ্জবশত কবিতালেখায় হাত দেন। দীর্ঘকাল ব্যাপী সকলেই জানতেন ‘কবিতা' পত্রিকায় প্রকাশিত (চৈত্র ১৩৬২), ‘যম’ই তাঁর প্রথম কবিতা, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘দেশ' (২০ মে, ১৯৯৫) পত্রিকায় তাঁর দুটি বিস্তৃত কবিতা সংকলিত হয়েছে; ‘অস্ফুট যৌবনাকে’ এবং ‘পথের ধারের কোন মেয়েকে' শিরোনামে সে দুটি রচনা বাগবাজারের বহ্নিশিখা সঙ্ঘের মুখপত্র ‘বহ্নিশিখা’ পত্রিকায় (৩ : ২, পৌষ ১৩৫৯) প্রকাশিত হয়, যেটির মুদ্রাকর ছিলেন শক্তি, কিন্তু কবিতাদুটির লেখক একই ব্যক্তি যথাক্রমে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং ছদ্মনামধারী স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার। প্রকৃতপক্ষে শেষোক্ত ছদ্মনামটি গ্রহণ করেছিলেন আরো তিন-চার বছর পূর্বে, যখন তিনি বাগবাজারের মহারাজা কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্র। বন্ধুদের নিয়ে, ৬০ গোপীমোহন দত্ত লেনের মামাবাড়িতে সে সময় তিনি প্রগতি নামে একটি পাঠাগার চালু করেছিলেন। তাঁর আবাল্য সহচর মামাতো ভাই অমল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন : ‘লাইব্রেরি থেকে ‘প্রগতি' নামে হাতে লেখা পত্রিকাও বের হল শক্তির সম্পাদনায়। পরে ‘প্রগতি'র নাম পাল্টে ‘নবোদয়' রাখা হয়। শক্তি এই নবোদয়-এ আমাদের সকলকে দিয়েও লেখাতো। তাতেও পাতা না ভরার দরুণ ও বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ধাঁচের তিন-চারটে লেখা লিখত। এ সময়ই ও স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ছদ্মনামটা প্রথম ব্যবহার করে।' মাতুলালয়ের নিচতলায় প্রেসঘর থেকে ‘মাঝরাতে আধো ঘুমে ফ্লাট মেশিনের কাতর ক্রন্দনধ্বনি' শুনে মনে মনে শক্তি ভাবতেন হয়তো বা তাদের হাতে লেখা কাগজগুলি অত্যন্ত সুদৃশ্য টাইপে ছাপা হয়ে যাচ্ছে, কাল প্রত্যুষে সেগুলি বাঁধাই ঘরে দেখা যাবে। তার বালককালের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছিল খুব শীঘ্রই। আলোচ্য স্মৃতিচারণে অমল আরো জানিয়েছেন : ‘বোধহয় শুধু হাতে লেখা পত্রিকা আর লাইব্রেরির মধ্যে শক্তি তৃপ্তি পাচ্ছিল না।
জন্ম: নভেম্বর ২৫, ১৯৩৪ সালে জীবনানন্দ-উত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান আধুনিক কবি। বাঙালি-ভারতীয় এই কবি বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশেষভাবে পরিচিত এবং আলোচিত ছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ এর জয়নগর - মজিলপুরের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বামানাথ চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার কাশিমবাজার স্কুলে পড়তেন। দারিদ্রের কারণে তিনি স্নাতক পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়েন এবং সাহিত্যকে জীবিকা করার উদ্দেশ্যে উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন। কলেজজীবনে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। প্রথম উপন্যাস লেখেন কুয়োতলা। কিন্তু কলেজ - জীবনের বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বনাঞ্চল - কুটির চাইবাসায় আড়াই বছর থাকার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একজন সফল লিরিকাল কবিতে পরিণত হন। একই দিনে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলার অভ্যাস গড়ে ফেলেন তিনি। শক্তি নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য। ভারবি প্রকাশনায় কাজ করার সূত্রে তার শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজ বের হয়। পঞ্চাশের দশকে কবিদের মুখপত্র কৃত্তিবাস পত্রিকার অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার উপন্যাস অবনী বাড়ি আছো? দাঁড়াবার জায়গা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। রূপচাঁদ পক্ষী ছদ্মনামে অনেক ফিচার লিখেছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম, হে নৈশব্দ' ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় দেবকুমার বসুর চেষ্টায়। ১৯৭০ - ১৯৯৪ আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেছেন। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলন - এর জনক মনে করা হয় তাঁদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম । সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার সহ তিনি একাধিক পুরস্কারে সন্মানিত । তিনি মার্চ ২৩, ১৯৯৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।