জসীমউদ্দীন (১৯০৩ - ১৯৭৬)। তখনও তিনি স্নাতকের ছাত্র, তার কবিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পাঠ্য’ হয়ে ঢুকে পড়ল 'ম্যাট্রিক সিলেকশন'-এ। রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি জানালেন : ‘কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের'...। 'পল্লীকবি' হিসেবে তাঁর অবিসম্বাদী শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা মিলল পাঠকের দরবারে। পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র মুসলমান পরিবারের এই সন্তানের চলার পথে কুসুম বিছানো ছিল না। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যের পীঠস্থানে তাঁর প্রবেশ ও স্বীকৃতি অর্জন--যেন ইচ্ছাপূরণের কোনো অবিশ্বাস্য কাহিনি । জসীমউদ্দীনের কবিজীবনের নির্মাণপর্বের অনুপুঙ্খ বৃত্তান্ত ধরা আছে তাঁর ঐকাধিক স্মৃতিকথায়। একই সঙ্গে আছে সমসময়ের নির্ভরযোগ্য চালচিত্র। শুধু বাংলার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, তার সামাজিক এবং আন্তঃসম্প্রদায় বহুমাত্রিক সম্পর্কের ইতিহাসেরও মূল্যবান আকর-বিশেষ এই স্মৃতিকথাসমগ্র। সমাজের বহুমানিত পুরোধা পুরুষদের কীর্তিগাথার পাশে বিপরীত মেরুর অকিঞ্চিৎকর প্রান্তিক জনেরাও তাঁদের অন্তরঙ্গ উপাখ্যান নিয়ে উঠে এসেছেন সেখানে। এই সমস্ত অনাড়ম্বর ও অকপট স্মৃতিকথার প্রতি পঙ্ক্তিতেই যেন মানুষ জসীমউদ্দীনকে স্পর্শ করা যায়। জসীমউদ্দীনের সবক'টি স্মৃতিকথাগ্রন্থ, ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা তাঁর অন্যান্য সমধর্মী রচনা সমেত, দুই মলাটের ভিতরে এখানে। অতিরিক্ত প্রাপ্তি দুটি অপ্রকাশিত রচনা। এছাড়া, ‘প্রাসঙ্গিক তথ্য' অংশে মূল গ্রন্থের বিবিধ প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গের সুত্রে বিপুল পরিমাণ তথ্যের সমাবেশ, সম্পাদকীয় টীকা-ভাষ্য, জসীমউদ্দীনের অপ্রকাশিত ব্যক্তিগত নথি-চিঠিপত্র-পাণ্ডুলিপি ইত্যাদির সুপ্রচুর সদ্ব্যবহার একে স্পৃহণীয় করে তুলেছে।
কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর শৈশব কাটে। তাঁর পিতা আনসার উদ্দীন সেখানে একজন স্কুল শিক্ষক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তিনি এলাকায় প্রেসিডেন্টও ছিলেন। কবির মাতা রাঙাছুটু ছিলেন একনজন গৃহবধূ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অধ্যয়নকালে ও লাভের পর জসীম উদ্দীন প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে ‘রিসার্চ ফেলো’ পদে কর্মরত ছিলেন । দীনেশ সেন সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন পল্লী এলাকার মানুষের মুখে গীত-পঠিত পুথি সংগ্রহ ও গবেষণা করতেন । ড. সেন তার উপযুক্ত শিষ্য জসীম উদ্দীনকে বাংলার জেলাগুলোর বিশেষভাবে ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার সেইসব পুঁথি (কাব্য-লোকগাথা) সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। জসীম উদদীন পুথি সংগ্ৰহকালে গ্রামীণ জনগণের আনন্দ-বেদনার কাব্যগাথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, মানুষকে ভালোবেসে একজন খাটি মানবপ্ৰেমী হয়ে ওঠেন। কবি পালাগান, গাজীর গান, জারীগান, লোকগীতির আসরে যেতেন, উপভোগ করতেন, মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও লোকসঙ্গীতের আসরের আয়োজন করতেন । লোকগীতিতে সুরারোপ করেন ও বিশিষ্ট শিল্পীদের গান শেখান এবং পরবর্তীকালে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন । লোকসংস্কৃতির উপাদান প্রত্যক্ষ করেন। জসীম উদদীন কবিতা, নাটক, উপন্যাস, কাব্যোপন্যাস, প্ৰবন্ধ, ত্য গবেষণাগ্রন্থ, গান, ভ্রমণকাহিনী এবং ও স্মৃতিকথাসহ অর্ধশতাধিক বইয়ের রচয়িতা। কবি দুইবার এডিনবাৰ্গ উৎসবে (১৯৫০ ও ১৯৬২ সালে) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভয়াসহ বহু দেশে অনেক লোকসংস্কৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রন্থগুলো বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে : ১৯৭০ সালে UNESCO তাঁর “সৌজন ব্যাদিয়ার ঘাট” ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও প্ৰকাশ করে । কবির ’মাটির কান্না’ কাব্যগ্রন্থটি রুশ ভাষায় একটি সংস্করণ বেরিয়েছে। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ কবি ইহলোক ত্যাগ করেন ।