১৯২৭ থেকে ১৯৪২ এই পনেরোটি বছরের ঘটনাবহুল জীবনের শাব্দিক চিত্রণ এই খণ্ডটি। এই পনেরোটি বছরই রাহুল সাংকৃত্যায়নের জীবনের বহুমার্গীয় প্রয়াস, তাঁর অনুসন্ধান ও অন্বেষণের শ্রেষ্ঠতম পর্ব। এই সময়েই তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথা ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়। যার অন্যতম হল-তিব্বতযাত্রা ও সেই দুর্গম ভূখণ্ড থেকে একুশটি খচ্চরের পিঠ বোঝাই করে বৌদ্ধ পুঁথি উদ্ধার করে আনা, বহির্বিশ্ব দর্শন, কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দান, গ্রেপ্তার ও কারাবাস। এই সময়েই তাঁর বৌদ্ধিক জীবনচর্চা খণ্ডিত হয়। গভীর অধ্যয়নের জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয় দুর্বিষহ অব্যবস্থিত জীবন, এক মানুষের কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হয় বহু মানুষের আর্তনাদ, হাহাকার ও মুষ্টিবদ্ধতা। এর ভেতর দিয়ে রাহুল যেন পর্বে পর্বে নিজেকে উন্মোচিত করে চলেছেন। কখনো তিনি লেখক, সমাজ সংস্কারক, কঠোর সংগ্রামী, আবার কখনো কৌতুকপ্রবণ সহজ মানুষ। তাই এই বহুমাত্রিক গ্রন্থটির প্রতিটি পৃষ্ঠাই একজন সচেতন শিল্পীর আত্মোন্মোচনের ভাষ্য, যা কখনোই ছদ্ম-পাণ্ডিত্যের ভারে ন্যুব্জ নয়, তা একান্তই বিদ্যালংকারবর্জিত, সরল ও মর্মস্পর্শী। আর তাই তা শুধুই রাহুল সাংকৃত্যায়নের জীবনচরিতে সীমাবদ্ধ নেই, হয়ে উঠেছে এক গ্রন্থবদ্ধ মানবেতিহাস। অখণ্ড মনীষা নিয়ে এখানেই যেন রাহুল সাংকৃত্যায়নের পূর্ণ উদ্ভাসন।
তাঁর জন্ম ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে সনাতন হিন্দু ভূমিহার ব্রাহ্মণ পরিবারে। জন্মস্থান উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের একটি ছোট্ট গ্রাম। তাঁর আসল নাম ছিল কেদারনাথ পাণ্ডে। ছোটোবেলাতেই তিনি মাকে হারান। তাঁর পিতা গোবর্ধন পান্ডে ছিলেন একজন কৃষক। বাল্য কালে তিনি একটি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। আর এটিই ছিলো তাঁর জীবনে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অষ্টম শ্রেণী অবধি অধ্যয়ন করেছিলেন। এখানে তিনি উর্দু ও সংস্কৃতের উপর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বহু ভাষায় শিক্ষা করেছিলেন যথা : হিন্দি, উর্দু, বাংলা, পালি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি ও রুশ।
পুরস্কার তালিকা পদ্মভূষণ (১৯৬৩) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৮)
ব্যক্তিগত জীবন জালিওয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড (১৯১৯) তাঁকে একজন শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী কর্মীতে রূপান্তরিত করে। এ সময় ইংরেজ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এ সময়টিতে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। পালি ও সিংহল ভাষা শিখে তিনি মূল বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা আকৃষ্ট হন এবং নিজ নাম পরিবর্তন করে রাখেন রাহুল (বুদ্ধের পুত্রের নামানুসারে) সাংকৃত্যায়ন (আত্তীকরণ করে যে)।, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি বিহারে চলে যান এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সাথে কাজ করা শুরু করেন। তিনি গান্ধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং এসময় তিনি গান্ধীজী প্রণীত কর্মসূচীতে যোগদান করেন। যদিও তাঁর কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না, তবুও তার অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য রাশিয়ায় থাকাকালীন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে শিক্ষকতার অনুরোধ করা হয়। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতে এসে তিনি ডঃ কমলা নামক একজন ভারতীয় নেপালি মহিলা কে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান হয়, কন্যা জয়া ও পুত্র জিৎ। পরে শ্রীলংকায় (তৎকালীন সিংহল) বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দার্জিলিংয়ে, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল তারিখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।