মোর জান প্রাণ ঐ লাল ধান আহারে তোল ভাই সব লক্ষ হাতে খামারে লাগরে সবাই কোমর বেঁধে বাহারে তোল ভাই ধান লক্ষ হাতে খামারে। পৌষের এই শিশির ভেজা ভোরেতে চল ভাই সব কাস্তে হাতে খেতেতে ও বউ শোন আলপনা দে দুয়ারে তুলবো ঘরে সোনার দানা এবারে।
বাংলার কৃষিজীবী গৃহস্থের পরম্পরাগত লোকশিল্প আলপনা। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে'—ঈশ্বরী পাটনীর সেই কবেকার ঈপ্সিত মনস্কামনা যেন যুগ যুগে ধরে প্রবহমান এই শিল্পধারার মধ্যে। সামান্য পিটুলিগোলায় আঙুল ডুবিয়ে নিমেষেই সৃষ্টি হয় অসামান্য নকশা শোভিত চিত্রপট। পরিবারের দেওয়াল, চৌকাঠ আর দৈনন্দিন গৃহস্থালির নানা সরঞ্জাম যেমন কুলো, সরা, পিঁড়ি ইত্যাদি হল ক্যানভাস। সৃষ্টির প্রেরণা আসে প্রকৃতির নানা উপকরণ যেমন সূর্য, চাঁদ, নদী, ফুল, পাতা আর সুন্দর সাজানো সংসারের অনাবিল স্বপ্ন থেকে। তাই আলপনার নকশার ভিতর থেকে উঁকি দেয় ধানের মরাই, পুকুর ভর্তি হাঁস আর সচ্ছলতার নানা টুকরো টুকরো ছবি। মানুষের ইতিহাস বড়ো বিচিত্র। যুগ যুগ ধরে প্রবহমান এই ইতিহাসের সন্ধান মেলে তার সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মধ্যে। আলপনা এমনই এক সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী লোকশিল্প। সম্পূর্ণ স্ত্রী-আচার কেন্দ্রিক এই শিল্পটি ব্রত, পার্বণ, পুজো, অনুষ্ঠান প্রভৃতির সঙ্গে মাঙ্গলিক উপচাররূপেই যুক্ত। আলপনা কৃষিভিত্তিক সমাজের অবদান হলেও প্রাগৈতিহাসিক চিত্রকলার সঙ্গে এর একটি নিবিড় সংযোগ রয়েছে তা হল জাদুবিশ্বাস । উভয় শিল্পকলার উদ্দেশ্য একটাই—জাদুশক্তির সক্রিয়তার সাহায্যে ইহজাগতিক কামনা বাসনার বাস্তবায়ন।
প্রফেসর ড. Borunkumar Chocroboti পিএইচডি, ডিলিট কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় (ভারত) লোকসংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও পশ্চিমবঙ্গে প্রথম লোকসংস্কৃতির প্রফেসর পদে আসীন হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রিফিথ পুরস্কারে সম্মানিত করেছেন ‘বাংলা প্রবাদে স্থান-কাল-পাত্র' গ্রন্থটির জন্য, আশুতোষ স্বর্ণপদকে বিভূষিত করেছেন ‘বাংলা লোকসাহিত্য চর্চার ইতিহাস' গ্রন্থটির জন্য। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় লোকসংস্কৃতি চর্চার জন্য দীনেশ চন্দ্র সেন পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। লাভ করেছেন পারুল পুরস্কারও। ইন্ডিয়ান ফোকলোর কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পদে আসীন, “লৌকিক’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি; ‘লোকশ্রুতি’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধীন লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রের পরিচালকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। ঐ কেন্দ্রের প্রকাশনা সমিতির সভাপতি; পঞ্চাশের অধিক গবেষকের গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক; নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আলোচনা সভায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী; দুই বাংলার গরিষ্ঠ লোকসংস্কৃতিবিদরূপে মান্যতার অধিকারী, লোকসংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটি আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও লোকসংস্কৃতি চর্চায় সমানভাবে সক্রিয় রয়েছেন।