স্বনামধন্য দীনেশচন্দ্র সেন তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী ফেলো। তাঁর উৎসাহে ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি অঞ্চল থেকে চন্দ্রকুমার দে, আশুতোষ চৌধুরী, নগেন্দ্রচন্দ্র দে ও জসীমউদ্দীন সংগ্রহ করেন বাংলা মৌখিক সাহিত্যের নানা নিদর্শন। পঞ্চান্নটি গীতিকা দীনেশচন্দ্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় চারখণ্ড ‘পূৰ্ব্ববঙ্গ-গীতিকা’১৯২৩ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে। এর প্রথমটি ছিল ‘ময়মনসিংহ গীতিকা”। সেটি প্রকাশের সঙ্গেই চারদিকে সাড়া পড়ে যায়, পরবর্তী খণ্ডগুলোও পাঠকের কৌতূহল টিকিয়ে রাখে। গীতিকাগুলির দীনেশচন্দ্রকৃত ইংরেজি অনুবাদ চার খণ্ড Eastern Bengal Ballads নামে প্রকাশিত হয়ে পাশ্চাত্যের বিদ্বজ্জনদের অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এসব গীতিকার কালনির্ণয় করা চলে না, তা আবহমান কালের। এসবের মধ্যে রয়েছে বিশ্বসাহিত্যের সুর। মানবজীবনের চিরন্তন প্রেম-ভালবাসা, ঈর্ষা-দ্বন্দ্ব, উদারতা-নীচাশয়তার সরল প্রকাশ এতে। পল্লীর জানা-অজানা কবিরা সে প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন বাংলা ভাষায়, তার জন্যে আমরা গৌরবান্বিত। দীনেশচন্দ্রের অবলম্বিত পাঠের এই পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হল লোকসংস্কৃতিবিদ শীলা বসাকের ভূমিকাসহ
(১৮৬৬-১৯৩৯) ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা জেলার বগজুরী গ্রামে জন্ম নেন দীনেশচন্দ্র সেন। ব্রাহ্ম-বিশ্বাস অনুসারী শিক্ষক-উকিল ঈশ্বরচন্দ্র সেন ও সনাতন ধর্মাবলম্বী রূপলতা দেবীর সন্তান ছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকে বাংলা ভাষা ওসাহিত্যের গবেষণায় তিনি সাধক হয়ে ওঠেন। ঢাকার বিভিন্ন স্কুল ও ঢাকা কলেজে অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি এন্ট্রান্স ও এফ. এ. (ইন্টারমিডিয়েট) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট ছাত্ররূপে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। তিনি হবিগজ্ঞ হাইস্কুল, কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইনস্টিটিউশন ও ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার নিযুক্ত হন এবং পরের বছরই তিনি সিনেট সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ১৯১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলাে নিযুক্ত হন। ১৯২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে অভিষিক্ত হন। পরের বছর তাঁকে ডি. লিট. (ডক্টর অব লিটারেচার) উপাধি দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই পণ্ডিত অসম্ভব নিষ্ঠাবান শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাঁর মতাে মানবপ্রেমী সমাজে দুর্লভ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরেক দিকপাল কবি জসীম উদ্দীনকে দীনেশচন্দ্র সেনের পিতৃতুল্য অভিভাবকত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। পূর্ব বাংলার প্রাচীন গীতিকবিতা (পুঁথি) সংগ্রহে বিশেষভাবে ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহে কবি জসীম। উদদীন কাজে লাগিয়েছিলেন। বাংলার প্রাচীন পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনায় দীনেশচন্দ্র সেন বিশাল ভূমিকা রেখে গেছেন। বাংলা ও ইংরেজিতে কাব্যগ্রন্থ, ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগ্রন্থ সব মিলিয়ে তাঁর সত্তরখানা অত্যন্ত মূল্যবান বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ময়মনসিংহ গীতিকা ইংরেজী ও ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করান এবং নিজে ইংরেজীতে ‘History of Bengali Language and Literature' পুস্তক রচনা করেন; এই বইটি রবীন্দ্রনাথের নােবেল প্রাইজ পাওয়ার পথ সুগম করে। ৭৫ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন ইহলােক ত্যাগ করেন।