ভূমিকা পণ্ডিত রজনীকান্ত চক্রবর্তী রচিত গৌড়ের ইতিহাস গ্রন্থটি সম্পর্কে আলোচনার প্রারম্ভে বলে নেওয়া প্রয়োজন যে গ্রন্থটি বাঙলাভাষায় লেখা অখণ্ড বঙ্গভূমির প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। অনেক সময় অনবধানতাবশত গৌড়ের ইতিহাসকে আঞ্চলিক ইতিহাসের তালিকাভুক্ত করা হয়। আঞ্চলিক ইতিহাসের তালিকায় গৌড়ের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্তি বিভ্রান্তিকর। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণার অস্বচ্ছতা এই বিভ্রান্তির জন্য দায়ী । নিম্ন উত্তরবঙ্গে গঙ্গার একটি পরিত্যক্ত খাতের উপর অবস্থিত গৌড় তথা লক্ষণাবতী নগরীর ধংসাবশেষকে স্থানীয় একটি জনপদের ধংসাবশেষ হিসাবে বিবেচনা করার লৌকিক প্রবণতা অনেক শিক্ষিত মানুষকেও প্রভাবিত করে। ফলতঃ, গৌড় শব্দটি পূর্বভারতের একটি প্রাচীন রাষ্ট্র ও তার প্রধান নগর তথা রাজধানীর পরিচয়বাহী না হয়ে এখনকার মালদা জেলার দক্ষিণাঞ্চলের একটি এলাকার পরিচয়বাহী হয়ে পড়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে এমন কি ঊনবিংশ শতকে কিংবা বিংশশতকের গোড়ার দিকেও ‘গৌড়’ শব্দটির ব্যবহার এত সীমিত অর্থে করা হ'ত না। গৌড়ের ইতিহাসের আধুনিক পাঠকের স্বার্থে আমাদের বলে নিতে হবে যে প্রাচীন ও মধ্যযুগে অনেকসময় ‘গৌড়’ ও ‘বাংলা’ এই দুটি শব্দ সমার্থক ছিল। অতি প্রাচীন কাল থেকেই গৌড় নামটি সুপরিচিত ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও গৌড় নামক জনপদের উল্লেখ আছে। একই গ্রন্থে সমকালীন বস্ত্রের প্রকারভেদ বোঝাতে ‘পৌণ্ড্রক’ ও ‘বঙ্গক’ শব্দ দুটিরও ব্যবহার করা হয়েছে।' অর্থাৎ পৌণ্ড্র এবং বঙ্গ এই দুটি অঞ্চলও খ্রীষ্টপূর্ব যুগে অপরিজ্ঞাত ছিল না। মহাস্থানগড়ে (বাংলা দেশের অন্তঃপাতী বগুড়া জেলায় অবস্থিত) প্রাপ্ত একটি লিপিখণ্ডে পুণ্ড্রনগরের উল্লেখ তার অতিরিক্ত প্রমাণ। এই লিপিখণ্ড খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের। অপরপক্ষে বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা` বা বাৎস্যায়নের কামসূত্রেও° গৌড়ের উল্লেখ রয়েছে। বস্তুতঃ পূর্ব ও উত্তরভারতের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত একটি বৃহৎ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে অথবা উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ হিসাবে গৌড়, পুণ্ড্র বা বঙ্গের উল্লেখ বহুতর।
সপ্তম শতাব্দীতে মহারাজ শশাঙ্ক তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্টের কাব্যে ‘গৌড়াধিপ' নামে উল্লিখিত হয়েছেন। তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণের অবস্থিতি ছিল রাঢ়ের অন্তঃপাতী মুর্শিদাবাদ জেলায়।“ রমাপ্রসাদ চন্দ্র তাঁর গৌড়রাজমালায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে সংস্কৃত অভিধানে গৌড় শব্দের পর্যায়ে 'পুণ্ড্র', 'বরেন্দ্রী' এবং 'নীবৃতি' উল্লিখিত আছে। এছাড়া অষ্টম শতকের কবি বাকপতি তাঁর ‘গৌড়বহ’ কাব্যেও গৌড় শব্দের প্রভূত ব্যবহার করেছেন। পালসম্রাট ধর্মপাল প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রকূট রাজকীয় শাসনে ‘গৌড়েন্দ্র বঙ্গপতি’