প্রসঙ্গ কথা লোকসাহিত্যে দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল সাতক্ষীরা। এর প্রায় সকল শাখায় রয়েছে এ অঞ্চলের বিশেষ অবদান। বিশেষ করে এখানকার লোককাহিনীগুলো বিরল বৈশিষ্টেপূর্ণ ও অতিশয় চিত্তাকর্ষক। এই বিশেষত্বের মূলে রয়েছে এখানকার সমৃদ্ধ ইতিহাস, লোকঐতিহ্য ও বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান। স্থানীয় এই বৈশিষ্ট্যসমূহ জেলাকে এনে দিয়েছে আকর্ষণীয় এক স্বাতন্ত্র্য। আর লোককাহিনীগুলির ওপর কোনো না কোনোভাবে এসে পড়েছে তার সুস্পষ্ট প্রভাব। সত্যিই কি এখানকার স্বাতন্ত্র্যটা বড্ড প্রভাবশালী? একটু দেখে নেয়া যেতেই পারে। সাতক্ষীরার প্রাচীন নাম ‘বুড়নদ্বীপ’। সংক্ষেপে বুড়ন। এখানকার, আঞ্চলিক ভাষায় শব্দটির উচ্চারণ ‘বুড়নো ‘যার অর্থ হলো ডুবে থাকা। সুতরাং বুড়ন দ্বীপ হলো বুড়নো দ্বীপ বা ডুবে থাকা দ্বীপ। এককালে বুড়নের পুরোটাই বুড়ে বা ডুবে ছিল সাগরের পানির নিচে। উজান থেকে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র বয়ে আনা কোটি কোটি টন পলি জমে জমে গঠন করেছে নতুন ভ‚মি। সেই ভ‚মি পরিপূর্ণরুপে জেগে ওঠার আগে ডুবে থাকা দ্বীপ অর্থে বুড়নো দ্বীপ বা বুড়ন দ্বীপ পরিচিতি পায়। পরিপূর্ণরূপে জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বুড়নের উর্বর মাটিতে প্রচুর গাছ গাছালি গজিয়ে ওঠে। কিছুকালের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিশাল বনভ‚মি, সুন্দরবন। সেই বন কেটে সংগ্রামী মানুষেরা গড়ে তুলেছে বাড়িঘরÑ ক্ষেতখামার, পথঘাট, হাটবাজার, দিঘি, মসজিদ-মন্দির-গীর্জা, খেলার মাঠ, দরগাহ ইত্যাদি। এই বন কেটেই মহান আধ্যাত্মিক সাধক হযরত খানজাহান আলী যশোর থেকে সাতক্ষীরার তালার মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছিলেন বাগেরহাট। আর দাউদখান কররানী’র ধন ভাÐারের রক্ষক ‘শ্রীহরি ‘প্রভুর বিপদের সময় সমস্ত ধনরতœ লুটে নিয়ে এই বনে এসে আত্মগোপন করেন। তিনি বিক্রমাদিত্য নামধারণ করেন এবং বন কেটে ঐশ্বর্যশালী যশোর রাজ্যের পত্তন করেন। বিখ্যাত বারো ভূঁইয়া রাজা প্রতাপাদিত্য এই বিক্রমাদিত্যের পুত্র। প্রতাপও পরে আরো বন কেটে রাজ্যের পরিসীমা বৃদ্ধি করেন। এভাবে বন কর্তনের দরুণ ছোট হতে হতে সুন্দরবন বুড়নের দক্ষিণ প্রান্তে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বন কেটে গড়ে ওঠা অবশিষ্ট বুড়নে বিস্তার ঘটে আধুনিক সভ্যতার। বুড়নের অবস্থান দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। এই কোণের নাম নৈর্ঋত। তাই সাতক্ষীরা হলো নৈর্ঋতের জেলা। এই কোণটি গহীন জঙ্গল আর সমুদ্রের মিলনরেখার অবস্থিত। এখান থেকে পূর্বদিকে সাগর ও ভ‚মির মিলনরেখা জুড়ে রয়েছে সুন্দরী সুন্দরবন। অতুল সৌন্দর্য ও সম্পদে ভরা আর রহস্যেঘেরা এই সুন্দরবন যেন রূপকথার এক সাম্রাজ্য। এটি যেমন সুন্দর সুন্দর বৃক্ষের বন তেমনি শুলোরও বন। এই বনে বাস করে জগতের বিখ্যাত বাঘ ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’। বনের ভেতর জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদীনালা। তাতে আছে বড় বড় কামোট, কুমির। সুন্দরবনের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলা হয়-‘ডাঙায় বাঘ,নদীতে কুমির’। এই না হলে নৈর্ঋত আর কেন ? নৈর্ঋত তো শুধু দক্ষিণ-পশ্চিম কোণই নয়, রাক্ষসও। রাক্ষস ভয়ংকর এক দৈত্য। বিকট মূর্তি ধরে সে মানুষের ঘাড় মটকিয়ে রক্ত পান করে। এই বিভীষিকা তো সুন্দরবনের নৈমিত্তিক ঘটনা। আজকের দিনেও এর কোনো ব্যত্যয় যে ঘটছে তাও তো নয়। কিন্তু এই ভয়ংকর রক্তপায়ীকে ‘রাক্ষস’ না বলে ‘বাঘ’ বলা হচ্ছে- এই যা। আর রাক্ষসের যে বিদকুটে অবয়বচিত্র কল্পনা করা হয়, আক্রমনোন্মুখ বাঘের রুদ্রমূর্তি তার চেয়ে কোনো অংশে কম ভয়ংকর নয়। হতেও তো পারে ভীম রুদ্রমূর্তির ঐ ব্যঘ্রচিত্রই রাক্ষস রূপকথার অনুঘটক। সাতক্ষীরার ইতিহাস-ঐতিহ্য আর লোকসং¯ৃ‹তির যেকোন আলোচনায় পটভ‚মি হিসেবে বুড়ন, সুন্দরবন, বাঘ, কুমির ইত্যাকার বিষয়গুলি খুবই প্রাসঙ্গিক। এখানকার লোককাহিনীর বর্ণনায় তো বিষয়গুলি অপরিহার্য। এখানে বাঘকে রাক্ষস হিসেবে দেখা না গেলেও অভিনব সৈন্য-বাহিনী হিসেবে ঠিকই দেখা যায়। বাহিনী এলে এসে যায় দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে গাজীপীরের যুদ্ধের কথা, এসে যায় সুন্দরবনের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে কিংবদন্তি নারী বনবিবির কথা, মাইচাম্পার কথা, রাজা মুকুট রায়ের কথা; এসে যায় গণরাজাদের বংশ নিপাতের মর্মস্পশী ঘটনার কথা। আবার বনভ‚মি ছাফ করে সভ্যতার পত্তন প্রসঙ্গে গেলেই গড়ে ওঠা প্রাচীন কীর্তিরাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন লোককথা ও কাহিনী বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসে পীর, ফকির, সাধক ও পাগলদের অলৌকিক ক্ষমতা ও মাহাত্ম্যকথা, অন্যের সম্পদ হরণ করে রাজা হওয়ার পরিণতি, অন্যের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে অকাতরে প্রাণদানের মাহাত্ম্যকথা, ভাগ্যখুলে যাওয়ার বিস্ময়কর ঘটনা এবং জমিদারদের জৌলুসপূর্ণ জীবন কথা ইত্যাদি। মূলত এধরনের পটভ‚মিতে বিচিত্র সব বিষয়াষয় নিয়ে গঠিত বিপুল লোককাহিনীর সম্ভার ছড়িয়ে আছে সাতক্ষীরাময়। এসকল কাহিনী সাধারণত গুরুত্বহীন মনে করা হলেও আদৌ তা নয়। বরং এগুলি জাতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মণি মাণিক্যতুল্য। সেকারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ও চাপা পড়ে থাকা অবস্থা থেকে এগুলি কুড়িয়ে এনে বৃহত্তর জনসমাজে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। ব্যাপক ফিল্ডওয়ার্কের মাধ্যমে সেটি করণীয়। কিন্তু কেন জানি এ নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সেজন্যে বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো কাজও হয়নি। আর এই না হবার দায় সাতক্ষীরার সন্তান হিসেবে আমিও এড়িয়ে যেতে পারি না। পারি না বলেই শেষ পর্যন্ত দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নিই। অনেক বিলম্বে হলেও এই দায়িত্ব নিতে পারাটাকে আমি গৌরবজনক মনে করছি। লোককাহিনীগুলি সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে ফিল্ডওয়ার্কের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা আক্ষরিক অর্থে এখানে অনুপস্থিত। তার মানে এই নয়, এর সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের কাজের সম্পর্ক নেই। ব্যক্তিগত নানা কাজে জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলায় একাধিকবার কিছুকালের জন্য আমাকে অবস্থান করতে হয়েছিল। পেশাগত কারণে সুন্দরবনে বারংবার সফরও করেছি। জীবনের প্রথম থেকে লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ততাহেতু বিভিন্ন স্থানে অবস্থান ও সফরগুলিও ছিল নানা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের কাজে কিছুটা হলেও নিবেদিত। কিন্তু এর ওপরেই পুরোপুরি নির্ভর করে আমি কাজটি করিনি। কাজটি হাতে নিয়ে নতুন করে ফিল্ডওয়ার্ক যেমন করেছি, তেমনি খুলনা, সাতক্ষীরা ও সুন্দরবন সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য সকলগ্রন্থ থেকে প্রয়োজনীয় বহু তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবহার করেছি। এক্ষেত্রে কোনো গ্রন্থের কোনো অংশ বা অংশ বিশেষ সরাসরি গ্রহণ করা হয়নি। সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে সাতক্ষীরার ইতিহাসও লোকঐতিহ্যের নিরিখে প্রতিটি কাহিনী নির্মাণ করা হয়েছে। কাহিনীগুলির মূলভাব যাতে কোনোভাবে ক্ষুন্ন না হয়, সেদিকে তীক্ষè দৃষ্টি রেখেছি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। কাহিনীর মৌলিকত¦ ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আঞ্চলিক জবান ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বক্তব্যের সাবলীলতা অব্যাহত থাকলেও গতি কিছুটা বিঘিœত যে হয়নি, তা বলা যাবে না । কিন্তু এই সীমাবদ্ধতাটুকু কাহিনীগুলির মান কোনোরূপ ক্ষুন্ন করবে না বলেই আমার বিশ্বাস। তথাপি গ্রন্থখানি আমি যে, সম্পূর্ণ দ্বিধাহীনচিত্তে সুধি পাঠক সমাজের হাতে তুলে দিতে পারছি, তা একেবারেই মনে হচ্ছে না। কেন যেন বারংবার মনে হচ্ছে লেখাগুলিতে কিছু দুর্বলতা রয়েই গেছে। এ ধরনের রচনাগুলি যে ভাবালুতা ও সাহিত্যরসের সিক্ততা দাবি করে তা যথার্থভাবে পুরণ করা যায়নি। এই অপূর্ণতার জন্য কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে চাই না। এর সকল অসম্পূর্ণতা আমার নিজেরই অপূর্ণতা। তারপরেও ভাবতে ভালো লাগছে, বাংলার লোকসাহিত্যের ভুবনে সাতক্ষীরার গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানটি তুলে ধরতে হাতের পাঁচ হিসেবে গ্রন্থখানি একটু হলেও কাজে লাগতে পারে। গ্রন্থটি প্রণয়নে পূর্বসূরী শ্রদ্ধাভাজন লেখক মির্জা নাথান, সতীশচন্দ্রমিত্র , এ এফ এম আবদুল জলিল, মোহাম্মদ তোহা খান, মুহাম্মদ আব্দুল হালিম এবং সমকালের প্রিয়ভাজন লেখক বদরু মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান, মিজানুর রহমান ও জহুরুল আলম সিদ্দিকীর গ্রন্থ থেকে অনেক তথ্য উপাত্ত গ্রহণ করেছি। তাদের সকলের প্রতি আমার ঋণ অপরিশোধ্য। এদের মধ্যে জহুরুল আলম সিদ্দিকী অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দুটি গ্রন্থ উপহার দিয়ে এবং লিখিত আকারে একটি কাহিনীর পুরো তথ্য উপাত্ত স্বপ্রণোদিত হয়ে সরবরাহ করে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। আমাকে তথ্য দিয়ে এবং নানাভাবে সাহায্য করেছেন-কবি কাজী রিয়াজুল ইসলাম, প্রিন্সিপাল এ কে হেলালী, অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান, এডভোকেট আবুবকর সিদ্দিক, হেকিম মোঃ আলী হোসেন, সাংবাদিক কাজী মোতাহার রহমান বাবু, মাস্টার গাজী আবদুর রাজ্জাক, কবি স, ম তৈয়বুর রহমান, কবি কে এম আমিনুর রহমান, কবি বেদুঈন মোস্তফা, কবি আমিনুল বাসার, লোকশিল্পী মিস হেলেন প্রমুখ। এরা অনেকেই আমার একান্ত আপনজন, কেউ কেউ পরম আত্মীয়, পরম ব›ধু ও বিশেষ শুভাকাংখী। তাদের সহযোগিতার কথা বিন¤্রচিত্তে স্মরণ করছি। বারংবার সংযোজনÑবিয়োজনের ঝামেলা হাসিমুখে গ্রহণ করে কাহিনীগুলির কম্পিউটার কম্পোজ সুচারুরূপে করে দিয়েছে স্নেহভাজন মহিউদ্দিন খন্ডলি। তার জন্য অনেক শুভ কামনা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রন্থটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসায় ঊষার দুয়ার প্রকাশনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পরিশেষে গ্রন্থখানি নানা প্রতিক‚লতা অতিক্রম করে আলোর মুখ দেখতে পারায় মহান আলামিনের দরবারে জানাই লক্ষ কোটি শুকরিয়া।