ভূমিকা বাংলা সাহিত্যে সর্বৃপ্রথম সফল প্রহসন রচয়িতা মাইকেল মধূসূধন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) । তিনি যখন গম্ভীর রসের নাটক লিখছিলেন তখনই আবার ফাঁকে ফাঁকে দুখানি’ প্রহসন লিখে প্রতিভার পরিচয় দেন।একখানি হলো ‘ একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০) আর অন্যখানি হলো ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০)। ডক্টর অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘ প্রথমখানিতে ইংরেজী শিক্ষিত ভ্রষ্টচার তরুণ যুবকদের কদাচারকে শানিত রঙ্গব্যঙ্গ এর ভাষায় দারুণ কশাঘাত করা হয়েছে, দ্বিতীয়খানিতে তথাকথিত প্রাচীন ব্রাহ্মণ-সমাজপতিদেরক চরিত্র ও লাম্পট্য খুব রসালভাবে বর্ণিত হয়েছে। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ পুরোপুরি রঙ্গরসের প্রহসন , কাহিনী নামমাত্র। কিন্তু ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ তে ক্ষীণভাবে কাহিনীও অনুসৃত হয়েছে। প্রথমটিতে নাগরিক কলকাতার তরুন সমাজ ও দ্বিতীয়টিতে গ্রাম্য বাংলার ধর্মধব্জী বৃদ্ধ এর আক্রমণ স্থল। তৎকালীন সমাজ, ব্যাক্তি, তাদের কদর্য চরিত্র ও নীতিভ্রষ্টতা কবি এমন কৌতুক ও ব্যঙ্গের মধ্যদিয়ে বর্ণনা করেছেন যে, বহুদিন কেউ তাঁকে এ বিষয়ে অতিক্রম করতে পারেন নি।”
‘একেই কি বলে সভ্যতা’র প্রধান চরিত্র নবকুমার। কলকাতার আধুনিকাতার আলোকে নবকুমার শিক্ষিত হচ্ছে। তার পিতা একজন পরম বৈষ্ণব এবং তিনি বৃন্দাবনেই থাকেন। একসময় তিনি কলকাতায় এসে বসত গড়েন। এই সুযোগে নবকুমার কলকাতার নব্যশিক্ষিতযুবকদের নিয়ে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে- উদ্দেশ্য মদ্যপা্ন ও বারবণিতা সঙ্গলাভ। একদিন ধার্মিক পিতার দৃষ্টি থেকে কৌশলে নবকুমারকে সরিয়ে নিয়ে কালীবাবু জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় পৌঁছে। নবকুমারের পিতা সন্দেহ পরায়র হয়ে অনুচরণ বৈরাগীকে পাঠান রহস্য উদঘাটনের জন্য। তার কাছে সব রহস্য প্রকাশ হয়ে পড়লে নবকুমার উৎকুচ দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়। তারপর যথারীতি ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার’ কাজ কর্ম চলে। নবকুমার অধিক রাত্রে মদ্যপান করে মাতাল হয়ে প্রলাপ বকতে বকতে ঘরে ফিরে। পুত্রের এই পরিণতি দেখে নবকুমারের পিতা কলকাতার বসতি উঠিয়ে নিতে মনস্থ করেন। এই হলো ‘ একেই কি বলে সভ্যতা’র মূল বক্তব্য। এই প্রহসেন দুটি অঙ্ক এবং প্রত্যেক অঙ্কে দুটি করে গর্ভাঙ্ক বা দৃশ্য রয়েছে। প্রথম অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্কের স্থান নবকুমার বাবুর গৃহ ও দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কের স্থান সিকদার পাড়া স্ট্রিট। দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্গের স্থান জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা ও দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কের স্থান হচ্ছে নবকুমার বাবুর শয়নমন্দিল।
‘বড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের আবহ পুরোপুরি দেশজ। যশোর -খুলনা-চব্বিশ পরগনা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের ফলে তা যথেষ্ট অর্থপূর্ণ হয়েছে। ডক্টর অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়-গম্ভীর রসের নাটকেল মধুসূধন দত্ত কতদূর সফল হয়েছেন সে বিষয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু প্রহসন দুখানিতে তাঁর যে অসাধারণ ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে, তার জন্য বাংলা নাট্যসাহিত্য তিনি দীর্ঘজীবী হয়ে থাকবেন। ---রহুল আমিন বাবুল বি. এ (অনার্স) এম, এ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি, ১৮২৪ – ২৯ জুন, ১৮৭৩) ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার। তাঁকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণ্য করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে জন্ম হলেও মধুসূদন যৌবনে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন নাম গ্রহণ করেন এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণবশত ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন আকৃষ্ট হন নিজের মাতৃভাষার প্রতি। এই সময়েই তিনি বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্যরচনা করতে শুরু করেন। মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য নামক মহাকাব্য। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি হলো দ্য ক্যাপটিভ লেডি, শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী (নাটক), পদ্মাবতী (নাটক), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, হেকটর বধ ইত্যাদি। মাইকেলের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যু হয় এই মহাকবির।