ভূমিকা মীর মশারফ হোসেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে প্রথম উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক। মুসলিম রচিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনাকাল থেকেই সমন্বয়ধর্মী ও স্বাতন্ত্র্যধর্মী দুটি ধারা দেখা যায়। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ‘সুধাকর’ দলের হাতে। কিন্তু এর অনেক আগেই মীর মশারফ হোসেন সমন্বয়ধর্মী ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। পরবর্তীকালে বহু মুসলিম সাহিত্যিক এই সাহিত্যধারা অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্যে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
মীর মশারফ হোসেন ১৯৪৮ সালে কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়া গ্রামে এক মীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আত্নচরিত ‘আমার জীবনী’ পাঠে জানা যায় যে, তিনি ছাত্র জীবন থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর ‘গ্রামবার্তা’ সম্পাদক হরিনাথ মজুমদার ওরফে ‘কাঙাল হরিনাথ’ তাঁর সাহিত্য শুরু ছিলেন। ‘গ্রামবার্তা’ এবং ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ নামক পত্রিকা দুটোতেই তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু হয়।
মীর মশারফ হোসেনের পূর্ব বাংলা গদ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য মুসলমান সাহিত্যসেবী দেখা যায় না। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বিষাদসিন্ধু’ হলেও বাংলা নাটকেও অবদান কম নয়। মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম নাট্যকার। তাঁর প্রথম নাট্য-রচনা ‘বসন্তকুমারী নাটক’ ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। মুসলিম নাট্যকার রচিত প্রথম নাটক হিসেবে এর গুরুত্ব বিদ্যমান।
মীর মশারফ হোসের দ্বিতীয় নাটক ‘জমিদার দর্পন’ । এটি তাঁর সবচেয়ে উজ্জল ও বস্তুনিষ্ঠ নাটক। ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলার প্রথম গণমুখী নাটক ‘নীলদর্পন’ । এতে মাটি সংলগ্ন মানুষের প্রকৃত সংলাপ রূপায়িক হয়েছে। একই সূত্রে রচিত মীর মশারফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পন’।
‘জমিদার দর্পন’ নাটকের কাহিনী সরল ও আড়ম্বহীন। নারীলোভী এব জমিদার এবং সুন্দরী পত্নীর অসহায় কৃষক স্বামীর প্রসঙ্গ এ নাটকের কাহিনীর মূল অংশ। জমিদার শ্রেণীর চরিত্র, তোষামোদের ছলচাতুারি, চাষা আবু মোল্লা এবং তার পত্নী নুরন্নেহারের নির্যাতন প্রভৃতি নিয়ে ‘ জমিদার দর্পন’ অতি বাস্তব ধর্মী নাট্যকর্ম।এ নাটকেও নটনটী আছে, গান আছে। বিচারালয়ে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ,ডাক্তার, দেশি দারোগা, পেশকার ইত্যাদি সমন্বয়ে যে নৈরাজ্য চিত্র অঙ্কিত হয়েছে ,তা বাস্তবতার দিক থেকে অতুলনীয়।
সাহিত্য ও শিল্পকর্মে সাধারণ ও অপরিচিত বেদনার কথা বেশি দৃষ্টিগোচার হয় না। আবু মোল্লা আর নুরন্নেহারের জীবন দান বিরাট সংবাদ ভাষ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে না। কিন্তু তাদের এমন মৃত্যুর ব্যঞ্জনা কোনোভাবে তুচ্ছ বা বিস্মৃত হবার নয়। জমিদার দর্পন নাটকের প্রধান চরিত্রের পরিণাম ও অসহায় জীবনভাগ্য নাটকটিকে ট্র্যাজেডির মহিমা দান করেছে। মীর মশারফ হোসেন ছিলেন বাস্তবাদী ও জীবনমুখী নাট্যকার। ‘জমিদার দর্পন’ নাটকে সে দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল। এই মহান শিল্পী ১৯১২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। রহুল আমিন বাবুল বি. এ (অনার্স) এম. এ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
(নভেম্বর ১৩, ১৮৪৭ - ১৯১২) ছিলেন একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক যিনি ঊনবিংশ শতাব্দাীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা গদ্যের ঊণ্মেষকালে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি বিষাদ সিন্ধু নামক ঐতিহাসিক রচনার জন্য সপুরিচিত ও সাধারণ্যে জনপ্রিয়। তিনি তৎকালীন বৃটিশ ভারতে (বর্তমান বাংলাদেশ) কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখাপড়ার জীবন কাটে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে ফরিদপুরের পদমদীতে ও শেষে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে চাকরি করে। তিনি কিছুকাল কলকাতায় বসবাস করেন। মীর মশাররফ হোসেন তাঁর বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। সাহিত্যরস সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনায় তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাস "বিষাদসিন্ধু" তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। তাঁর সৃষ্টিকর্ম বাংলার মুসলমান সমাজে আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করে। মীর মশাররফ হোসেন খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর একটি ছোট গ্রাম লাহিনিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তার জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির পদমদীতে অতিবাহিত করেন। তবে তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর বলে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু কিছু গবেষক তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর বলে দাবী করেন। তিনি মীর মোয়াজ্জেম হোসেন (মুসলিম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি) এবং দৌলতুন্নেছার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র আঠার বছরে বয়সে তারঁ পিতৃবন্ধুর কন্যা আজিজুন্নেসার সাথে বিয়ে হয়। ১৯১২ সালে দেলদুয়ার এস্টেটে ম্যানেজার থাকাকালেই মীর মশাররফ হোসেন পরলোকগমন করেন। তাকে পদমদীতে দাফন করা হয়।