"উত্তরকালের ছয় উপন্যাস" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: বাংলা কথাসাহিত্যের অবিস্মরণীয় শিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকৃতির সমগ্রতার সন্ধানে ছয় উপন্যাস’ প্রকল্প। উপন্যাসগুলি হল সার্বজনীন, নাগপাশ, চালচলন, মাশুল, প্রাণেশ্বরের উপাখ্যান ও শান্তিলতা। প্রথমটি প্রকাশিত হয় ১৯৫২-য়,। দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি ১৯৫৩-য়। চতুর্থটি লেখকের জীবদ্দশায় প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থ। পঞ্চমটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ-উত্তর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। ষষ্ঠ উপন্যাসটি লেখকের প্রয়াণ-উত্তর চতুর্থ তথা সর্বশেষ গ্রন্থ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হন ১৯৫৬ সালে। রচনার সময়কাল সম্পর্কে বিশদে বলার কারণ, স্রষ্টার জীবনের প্রান্তসীমা ছুঁয়ে আছে লেখাগুলাে। অভিজ্ঞতা ও মেধার সমাহারে ঋদ্ধ মননের সৃজন এই উপন্যাসগুচ্ছ। তার বিজ্ঞানী মনের জিজ্ঞাসা তখনও তীক্ষ, মানুষের অস্তিত্বের তাৎপর্য খুঁজছেন নিবিড় নিষ্ঠায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার তখনও অক্লান্ত তিনি। উপন্যাসে যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা, নতুন স্বাদ। সমগ্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-অনুধাবনে এই ছয় উপন্যাস শুধু মূল্যবান নয়, অপরিহার্য। বলা যায়, তাঁর সাহিত্যকর্মের সূচনাপর্ব যতটা গুরুত্বপূর্ণ, পরিণতি-পর্বও ততটাই। দীর্ঘ আঠাশ বছরের সাহিত্য পরিক্রমা প্রান্তবেলায় এসে জীবনদর্শনের যে উত্তর আখ্যানভাষ্যে ধরে রাখলেন, তার থেকে আমরা দূরে থাকি কীভাবে? এই সংকলনের বড়াে সম্পদ উপন্যাস-পরিচয়। রচনা ও প্রকাশের সাল তারিখের বিবরণের সঙ্গে এই পরিচয় আকারে-ইঙ্গিতে লেখক জীবনের। তাৎপর্যপূর্ণ একটি অধ্যায় তুলে ধরে, লেখকের ক্লান্তিহীন সংগ্রামের কথা বলে, তার মন ও মননের পথরেখারও সংকেত দেয়।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।