ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাবার আগে বাঙালি দিনে অন্তত একবার যাঁর নাম উচ্চারণ করে, তিনি রবীন্দ্রনাথ। তারপরেই দ্বিতীয় নাম—সত্যজিৎ রায়। লিখেছিলেন ‘বৈকুণ্ঠ পাঠক' ছদ্মনামে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। পারিবারিক সূত্রে সত্যজিৎ সেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। কবির দিনান্তবেলায় শান্তিনিকেতনে শিল্পচর্চার সময় সত্যজিতের সামনে খুলে যায় প্রকৃতির মায়াময় জগতের নন্দনকানন । তিনপুরুষের শোণিত ধারার স্বর্ণখনিতে তখনই বিস্ফোরণ ঘটে সৃজন প্রতিভার । বিলিতি বিজ্ঞাপন সংস্থার কারিগররূপে সত্যজিৎ বাংলা প্রকাশনা জগতে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। কিন্তু জীবনের অদৃশ্য প্রভাবে এই রূপতাপস ছবি থেকে ক্যালিগ্রাফি, সংগীতের ইন্দ্রজাল থেকে সাহিত্যের দ্বিতীয় ব্রহ্মাণ্ডসৃষ্টিকারী এক অনন্য পথিকৃৎ। তারপর ১৯৫৫-তে সত্যজিতের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী' মুক্তি পাবার পর বিশ্বচলচ্চিত্রের আকাশ এক আশ্চর্য জ্যোতিষ্কের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল। এই নতুন শিল্পমাধ্যমে সত্যজিতের ভুবনজয়ী প্রতিভা সাহিত্য, সংগীত, সুর, আলো, ব্যক্তি থেকে প্রকৃতি, ক্যামেরা, মায়া, দৃশ্য ইত্যাদি নিয়ে একটি সাত রাজার রত্নভাণ্ডার বানিয়েছে। একদিন তাঁর বহুমুখী প্রতিভার উন্নতশির বিশ্ব ছাপিয়ে মহাকালকে অতিক্রম করেছে। জীবনের মধ্যভাগ থেকে এই মহাস্রষ্টা হীরের মতো রামধনু রঙের সব গল্প লিখে গেছেন। সত্যজিতকে 'সর্বকালের তিনজন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের অন্যতম’ অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে—অন্য দুজন হলেন চার্লি চ্যাপলিন ও ইঙ্গমার বার্গম্যান। মনীষা ও মননের সেই অবিনশ্বর বোধিবৃক্ষের মহাজাগতিক সৃষ্টিধারার স্মরণীয় বছরে এই বই একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য।