“মুক্তিযুদ্ধে শিশু - কিশোরদের অবদান" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষিতে একাত্তর ছিল একটি বিশেষ সময়, সামগ্রিক অর্থেই। এমন সময় পূর্বে আর কখনাে আসেনি, তার পরেও না। ভবিষ্যতে যে আসবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। পৃথিবীর যেসব দেশ (চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা) জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বলে দাবি করে তারা আদতে কউমিজম প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছে। তার অর্থ একটি বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্বাসের অনুসারীরা সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে তেমনটি হয়নি। স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সব বাংলাদেশিরাই এ-যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ অবদান রাখেন। ব্যতায় কেবল পাকিস্তানিদের সহযােগী এদেশীয় কিছু কুলাঙ্গার। প্রাসঙ্গিকভাবে শিশু ও কিশাের বলতে বয়সের সংজ্ঞায়ন বিষয়ে আলােকপাত করা আবশ্যক। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (পরিমার্জিত সংস্করণ, ২০০০) অনুযায়ী ১০ বৎসর পর্যন্ত সন্তানদের শিশু বলা হয়েছে। ১১ থেকে ১৫ বৎসর পর্যন্তদের বলা হয়েছে কিশাের। কিশাের এবং তরুণ এর অর্থ এই ভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে অভিধানটিতে। এ-বইয়ে আমি কিশাের বা তরুণদের বয়স ১৬ পর্যন্ত বা দশম শ্রেণির ছাত্র পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করেছি। সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের শ্রেণি ও বয়সানুযায়ী একটি পরিসংখ্যান দেখা যায় মােট মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা (যুদ্ধ করতে সক্ষম প্রাক্তন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বাঙালি সৈনিক, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যসহ) ১,২০,০০০। বন্ধনীর মধ্যে সৈনিকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪২,০০০। অর্থাৎ গণযােদ্ধা ছিল (১,৩০,০০০-৪২,০০০) ৭৮,০০০। এই ৭৮,০০০ গণ যােদ্ধাদের প্রায় ২৩ ভাগ ছিল শিশু-কিশাের অথাৎ ১৭,৯৪০। এই পরিসংখ্যান একটি যুক্তিনির্ভর অনুমান। শিশু যােদ্ধাদের সংখ্যা কম হলেও বয়সের বিচারে তাদের ভূমিকা ও অবদান উল্লেখ করার মতাে। এবং এ শিশুরা সবাই গ্রামীণ জনপদের। শিশুরা পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা অবস্থান রেকি (পর্যবেক্ষণ) করে যে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে গ্রাম্য ভাষায় প্রতিবেদন দিতাে সে ভিডিও আমার কাছে আছে। তাদের বুদ্ধিমত্তা, কৌশল, মৃত্যু ঝুঁকি ও বুকভরা দেশপ্রেম বাস্তবিকই অহংকার করার মতাে। একাত্তরে শিশু-কিশােরদের রণাঙ্গনের অবদান সব সংগ্রহ করা আজ একচল্লিশ বছর পরে আর সম্ভব নয়। তবে যা সংগ্রহ করা হয়েছে তাও সংখ্যায় কয়েকশত। শিশু-কিশােরদের হাতে পুরু একটা বই ধরিয়ে দেয়া বােধ হয় ঠিক হবে না, দামও পড়বে বেশি। এ-বইয়ে তাই কিছু প্রতীকী ঘটনা অন্তর্ভূক্ত করা হলাে। প্রয়ােজন হলে ভবিষ্যতে বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বহু কষ্টের সংগৃহীত গৌরবের এ-কাহিনীগুলাে লিপিবদ্ধ করে না রাখাও অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এ-বইয়ে সব সত্য না থাকলেও শিশু-কিশােরদরে কৃত্য এ বইয়ে সত্য বৈ আর কিছুই নেই।
জন্ম : ২৪ জুলাই ১৯৫২। ঝিনাইদহ ক্যাডেট টি কলেজে যখন তিনি এইচএসসি পরীক্ষার্থী, তখনই ডাক এল মুক্তি সংগ্রামে। যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে এক তরুণ গণযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের দুই কিংবদন্তি মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন হায়দারের সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে পাশে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের হিরন্ময় দিনগুলিতে।একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের পাশাপাশি নিজেকে শাণিত করেছেন স্বদেশপ্রেমের এক প্রগাঢ় চেতনায়। বাহাত্তরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নির্বাচিত হলেও বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠায় বিলম্বের কারণে চুয়াত্তরের ৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং পচাত্তরের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীতে জিড় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এ কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৮৩ সালে বেইজিং ল্যাংগুয়েজ এন্ড কালচার ইউনিভার্সিটি থেকে চীনা ভাষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি । লাভ করেন। তারপর ১২ জুলাই ১৯৯৬ সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন-এ যেমন উচ্চ শাঘার, একমাত্র পুত্র শিশু সাবিতের মৃত্যু তেমনি তার হৃদয়ের গভীরতম ক্ষত । তবুও এ ক্ষত নিয়ে, এই বিক্ষত সময়ে তিনি সবুজআদৃত এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন । ,