জুলফিকার সম্পর্কে ক’টি কথা: মহানবী (সাঃ) বলেন, জ্ঞানই আমার অস্ত্র। হযরত আলী (কঃ) ও জ্ঞানকেই তাঁর অস্ত্র জেনেছেন। এ জ্ঞান নিরপেক্ষ কালের পরম জ্ঞান। এ জ্ঞান আসমানী জ্ঞান। এ জ্ঞানের উৎস মানবের মানস-গগনের গােপন প্রদেশ। নিরবধি কালের এ পরম জ্ঞানের সাহায্যেই যুগে যুগে মহামানবগণ অসত্য ও মিথ্যার বেড়াজালে বিভ্রান্ত মানবজাতিকে সত্য ও আলাের জগতে পৌছার নির্দেশ প্রদান করেন। এ পরম জ্ঞান প্রজ্ঞার সাহায্যে যে তলােয়ার দিয়ে আহলে বাইয়েত ও পাক পাঞ্জাতনের অন্যতম সদস্য হযরত আলী (কঃ) সারাজীবন অসত্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন তারই নাম জুলফিকার। বিগত প্রায় চৌদ্দশ’ বছর ধরে ইসলামের নামে মানবজাতির সামনে যেসব আচার-আচরণ চালু থেকে মুসলিম জাতিকে কল্যাণ ও আত্মােন্নয়নের পথে এগিয়ে না নিয়ে পরিণামে শুধু ক্রমাবনতির অতল গহ্বরে নিশ্চিতভাবে ঠেলে দিয়েছে কুরআন হাদিসের আলােকে রচিত অত্র জুলফিকার গ্রন্থের সাহায্যে লােকোত্তীর্ণ সাধক ফকির চিশতী নিজামীও সেই সব মিথ্যাচারের মূলোৎপাটনসহ বিভ্রান্তিমূলক নানা মতবাদ খণ্ডন করেছেন। এ গ্রন্থ পাঠে পাঠকগণ ধর্মের শাশ্বত কল্যাণকর গুণে উন্নীত চিরতরুণ মানবাত্মার অধিকারীত্ব অর্জনে নতুন দিকদর্শন লাভ করবেন বলে গ্রন্থকার বলিষ্ঠ আশা পােষণ করেছেন। কুরআন হাদিসে অসংখ্যবার আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করার তাগিদ রয়েছে। এ বিষয়ে মুহূর্তকাল চিন্তা করা সত্তর হাজার বছরের এবাদতের চেয়েও উত্তম (হাদিস)। দেড়হাজার বছর পূর্বেই রাসুল (সাঃ) বলেছেন, বিজ্ঞজনের কথা মন দিয়ে। শােনা এবং বিজ্ঞানের কথা অন্যত্র সঞ্চারিত করা ধর্মাচার অনুষ্ঠানের চেয়েও উত্তম। এর পরেও মুসলিম জাতি সৃষ্টি রহস্য তত্ত্ব জ্ঞানের গুরুত্ব দিতে নারাজ। এ জ্ঞানে নিজেকে চেনা সম্ভব। নিজেকে চিনলেই আল্লাহূকে চেনা হয়। অসীম জাতজগত থেকে মানুষ এ রূপময় জগতে এসে পুনরায় অসীমের পানেই তার অভিসার। শুধু মানুষ নয় কালাকালের উর্ধে সমস্ত সৃষ্টিই এক অনন্ত ঐক্যের সূত্রে গ্রথিত অথচ সৃষ্টি রহস্য জ্ঞানের অভাবে আজ বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির কালেও মানুষ ব্যক্তি স্বার্থ ভােগী আত্মার তৃষ্ণা মিটাতে সদা ব্যগ্র। মানুষকে এক না জানলে খােদাকে এক জানা হয় না। আর এই ‘এক’ জানার তাওহীদই ধর্ম বিশ্বাস। ব্যক্তিস্বার্থের মাতামাতিতে সে যে পক্ষান্তরে নিজের পরম ‘আমি’র চরম ক্ষতি করে চলছে তাও সে জানে না। এ জন্যই শান্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে থাকা সত্ত্বেও মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধ্বস নেমেছে যা ষষ্ঠ শতকের আরবজাতিকেও লজ্জায় ফেলবে। মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবােধ জাগ্রত করতে কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবী মনীষীরা নিরন্তর চেষ্টা করছেন। তাঁরা তাঁদের রচনায় নিরবধি কালের নিরপেক্ষ সত্যের অবতারণা করলেও কবির কবিতা বা সাহিত্যিকের গল্প-কাহিনী মনে করে সাধারণ পাঠক (বিরল ব্যতিক্রম ব্যতিত) শিল্পী সাহিত্যিকদের শিল্প কর্মের ধারে-কাছে আসতে চায় না । বিজ্ঞান সাধনা মানবের মস্তিষ্ক জগতের বাইরের কোন ব্যাপার নয়। ধর্মচিন্তা, সৌন্দর্য বা কল্যাণ চিন্তা, নিরাকার কাল-পরিসরে নিহিত অসীম বস্তু ও গুণ জগতের অনাবিষ্কৃত পরম সত্যকে বৈজ্ঞানিক তার পরম প্রজ্ঞার যে নিবিষ্টতায় সন্ধান করেন ধর্মতাত্ত্বিক-ও তাঁর পরম প্রজ্ঞার (ঐশী সজ্ঞা) গভীর মনােনিবেশে একই জগতের গুন শক্তির, সাহায্যে পরমসত্য উদঘাটন করেন। এ গ্রন্থে গ্রন্থকার সেই পরম জ্ঞানের আলােকে নিরাকার বস্তু জগতের পরম সত্যের হৃদয়গ্রাহী বিশ্লেষণ করেছেন। ধর্ম ও বিজ্ঞানে যে কোন অনৈক্য নেই এ গ্রন্থে তাও স্পষ্ট হয়েছে। তাই আমরা মনে করি বিজ্ঞানের বিচিত্র অগ্রগতির যুগেও মানবের অনাদি-অনন্তগুপ্ত-ব্যক্ত রহস্য জেনে জড় জগতের জীবনকে মহিমান্বিত করে তুলতে পাঠক মানুষ এ গ্রন্থের ধর্ম তাত্ত্বিক আলােচনায় নতুন সন্ধান পাবেন।
লােকোত্তীর্ণ আধ্যাতিক সাধক হযরত খাজা আহমেদ আব্দুল হক চিশতী (র.)। জীবকালেই যেমন নশ্বর জগতের মায়ানমাহের বন্ধন কাটাতে সক্ষম হয়েছেন তেমনি ফকির চিশতী নিজামী নাম ধারণ করে নামের বৃত্তাবদ্ধ পরিচিতিও মিটিয়ে দিয়েছেন। এ মহান সাধক ১৯২৫ সালের ১ জুলাই বৃহত্তর মানিকগঞ্জের সুতালরী গ্রামে (বর্তমানে পদ্মাগর্ভে বিলীন) হযরত খাজা রিয়াজউদ্দিন আহমেদ আল চিশতী (র.) এর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এন্ট্রান্স পাসকরে সরকারি চাকরিতে যােগদান করেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি ভাবুক ও গভীর চিন্তাশীল ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সৃষ্টিতত্ত্ব বিজ্ঞানে গভীর জ্ঞানের অধিকারী মহান আধ্যাত্মিক সাধক হযরত খাজা আনােয়ার আলী। শাহ চিশতী (র.) এর নিকট চিশতীয়া তরিকায় দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে সৃষ্টিতত্ত্ব ও সৃষ্টিকৌশল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। সরকারি চাকরিতে নিয়ােজিত থাকাবস্থাতেই আল কুরআনে বিবৃত শাশ্বত চল্লিশ’ এর মহিমান্বিত তালিমপ্রদান করে মানুষকে ভােগের নয়-ত্যাগের পথে, আল্লাহর পথে, আত্মবিসর্জনের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। এ মহান উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানা সদরে “আধ্যাত্মিক বিদ্যাপীঠ” নামে তারই প্রতিষ্ঠিত। বিদ্যাপীঠে ধ্বংসশীল ত্রিমাতৃক ভােগী আত্মার (জীবাত্মার) বিনাশ সাধনে অনুরাগীদের চতুর্থ মাত্রার রূহ ইনসানী তথা মানবাত্মার স্তরে উন্নীত করার শিক্ষা চালু করেন। (সৃষ্টি তত্ত্ব জ্ঞানে সমৃদ্ধ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবি মানসের আধ্যাত্মিক দিক আলােচনায় কুরআন ও হাদিসের আলােকে রচিত তার অমূল্য গ্রন্থ “আলােক শিশু” প্রকাশের পরপরই মৌলবাদীদের দায়েরকৃত মামলার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার। গ্রন্থখানির প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেন।) সাদৃশ্যাত্মক রূপকের আবরণ (allegorical| illustrative cloathing) ভেদ করে কুরআন ও হাদিসের গভীর সারসত্য। (theological meaning) চিত্তাকর্ষক ও প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি রহস্যতত্ত্ব ভিত্তিক বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করে গেছেন। জুলফিকার’, ‘আহলে বাইয়েত কিতাব ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ এবং ধর্ম ডাকাতি' ছাড়াও তাঁর বহু রচনা প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। সর্বত্রই এ যাবৎ কালে প্রচলিত সকল প্রকার রূপকাশ্রয়ী ধারার পরিবর্তে ইহকাল। ও পরকালে মানুষ’ই যে একমাত্র সারসত্য তা তিনি তার বক্তব্যে খােলাখুলি প্রকাশ করে। গেছেন। এ মহান সাধক ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর মঙ্গলবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে এ ধরাধাম ত্যাগ করে লােকান্তরে গমন করেন। ঈশ্বরগঞ্জ থানা সদরে তাঁর নিজ বাড়ীর আঙ্গিনায় এ মহান সাধকের মাজার অবস্থিত।