মুখবন্ধ এ বইটিতে উপস্থাপিত বিষয়সমূহে ধর্মের সত্য ভিত্তি অনুসন্ধান করা হয়েছে। সুতরাং একে কোনো মতবাদ মনে করার কারণ নেই। কেননা মানুষের বিশ্বাস ও এর আনুষঙ্গিক বিষয়াদী নিয়ে বিভিন্ন বিভক্তিগত মতভেদ ও মতবাদের ধারক ও বাহকগণ যেভাবে বাড়াবাড়ি করছেন এবং সাধারণ মানুষের ওপর জোরপূর্বক চাপানোর চেষ্টায় লিপ্ত আছেন, তাতে করে সাধারণ মানুষ প্রত্যেক মতবাদীর শ্রেষ্ঠত্ব দাবির বিচারে অত্যন্ত বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছে। সাধারণ অজ্ঞ জনগোষ্ঠীর সরলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মবিদাগণ নিজেদের আত্মভিমান পূরণ করার গোপন বাসনা নিয়ে এই সমস্ত বেদাতী মতবাদ প্রতিষ্ঠার দ্বারা নিজেদের আত্মভিমান ও গৌরব জাহির করছেন। ফলে বিভিন্ন মতবাদ নিয়ে মানুষের সরল বিশ্বাস (ঈমান) এখন ভীষণভাবে বিপত্তির মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে।
আমার মতো অতি সাধারণ একজন মানুষও মতবাদগত বিড়ম্বনার পড়ে দিকহারা, পথহারা হয়ে ধর্মের প্রথম ও প্রধান ভিত্তি বিশ্বাস (ঈমান) কিভাবে ঠিক রাখবো, তাই নিয়ে শঙ্কার দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে সত্যানুসন্ধান করার চেষ্টা করেন, তবে তিনি বা তারা আল্লাহর অত্যন্ত দয়া ও করুণা লাভ করে সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে থাকেন। কেননা বিশ্বাস, সৎপথ এবং উপাসনার মাত্রা সঠিকভাবে একজন মানুষের চেতনায় আল্লাহই প্রদান করতে সক্ষম। তাই নিজের অবস্থান ও জামানার তত্ত্ব প্রবাহের ক্ষেত্রগুলো অনুসন্ধান করার প্রবল বাসনায় তাড়িত হয়ে বিভিন্ন ঐশীগ্রন্থ পাঠ করা আরম্ভ করলাম। এর থেকে আদি বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি আমার চেতনায় অনুভব করে সামান্য কিছু জ্ঞান অর্জন করলাম। অবশেষে কোরআন আমাকে সঠিক রাস্তা দেখানো। অথবা বলতে পারেন আল্লাহ পাক আমার বিশ্বাসের সঠিক মাত্রা সংযোজন করে ধন্য করেছেন।
বর্তমান জামানায় সুন্নি মতবাদটি কিভাবে মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেধ করলো ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না। খুব বেশি দিনের কথা নয়, ষাটের দশকেও এদেশের বিশ্বাসী মুসলমানগণ চার ইমামের মতানুসারীগণ ধর্মের সঠিক রাস্তায় আছে এমন বিশ্বাস সর্বজন স্বীকৃত ছিরো। কিন্তু হালে, অর্থাৎ নব্বই এর দশক থেকে ‘সুন্নি’ শব্দটি দিয়ে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও এর কর্মকাণ্ড ‘সুন্নত’ দ্বারা প্রভাবিত করার চেষ্টায় জামানার আলেম-উলামাগণ বিভিন্নভাবে তত্ত্বগত বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। অতীতের চার ইমামের মত ও পথ যেন হঠাৎ কোনো যাদুর স্পর্শে সম্পূর্ণ হাওয়ায় উড়ে গেলো। ‘সুন্নি’ এবং ‘সুন্নত’ কোরআন দ্বারা সমর্থিত কি না, তার খোঁজ কেউ করলেন না। বিভিন্ন মতবাদের ধারক এবং বাহক গণ নিত্য নতুন ‘সুন্নত’ উৎপাদন করে, স্বমতের পক্ষে এমনই জোর প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে দৃশ্যত কোরআন বিমুখ করছেন এবং নিজ নিজ মতবাদ শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে বেশি অনুসরণযোগ্য প্রমাণ করার প্রেষণে একে অপরের ওপর সওয়ার হয়ে ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি প্রণয়ন করছেন। আত্মঘাতি বোমা হামলা, হাত-পায়ের রগ কর্তন অথবা অন্যমতের অনুসারী মানুষকে হত্যা করার মতো জঘন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করে বিশ্বাসী সাধারণ জনগণের স্বাভাবিক সুশীল জীবনকে আতঙ্কিত করে তুলেছেন।
কী করবে মানুষ? কার কাছে যাবে? এরই সাথে মতবাদের ধারক-বাহকগণ তাদের অনুসারীদের অর্থ বরাদ্দ, স্বর্গপ্রাপ্তির সনদ বিতরণ করা আরম্ভ করেছেন। সাধারণ মানুষও অর্থ- প্রাপ্তির উপায় পেয়ে অন্য মানুষকে হত্যা করায়, কড়ির বিনিময়ে খুন করার মতো অপরাধের সাথে যুক্ত হচ্ছেন। এর জন্য দায়ী কে? ধর্মমত? মতবাদ? অথবা মতবাদের আবিষ্কারক?
উপরক্ত অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার অথবা প্রসার প্রতিটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে আতঙ্কজনক হারে বেড়ে চলেছে। সংগত কারণেই আমার মত অনেক মানুষই ধর্ম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে। ধর্ম নিয়ে জোরাজুরি অথবা বাড়াবাড়ি করার অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো ন্যায়ের কতটা সমর্থন পাবে বিচেনা করা দরকার।
বর্তমান জামানায় মুসলিম মৌলবাদীদের মধ্যে বিভক্তিগত মতভেদ ও মতবাদগুরোর বাড়াবাড়ি এতো বেশি যে, এদের কারোরই অনুসরণ করার যৌক্তিকতা নেই। এমনতাবস্থায় মুসলমানগণের বিশ্বাস এবং সামাজিক শৃঙ্খলার যন্ত্রগুলোর সঠিক প্রয়োগনীতি অন্ধ কুশলতায় তলিয়ে গেছে। বিশ্বাস ও সমাজ শৃঙ্খলার যন্ত্রগুলোর মেরামত করা না হলে সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন মুসলিম মানস- এর একদল অরেক দলকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করার নামে জঘন্য অপরাধের বোঝা বহন করবে।
অবস্থার প্রেক্ষিতে যে সত্য মুষ্টিমেষ সুফি মতাদর্শের লোকদের মাঝে গোপন ছিলো তারই শরীয়ত এর মূলধারাটুকু প্রকাশ করার ঝুঁকি নিতে হলো। (বর্তমান জামানার পীরবাদ বা সুফি মতবাদগুলো সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর এবং ভণ্ডামিতে পূর্ণ) সেই মতে কোরআনের সর্বজনীন মূলধারা অনুসন্ধান করার মধ্যে দিয়ে মধ্যযুগের সুফি মতাদর্শের শরীয়ত বা রসূল (সাঃ)- এর প্রদর্শিত শরীয়তের মূলধারা ছিলো, তাই প্রকাশ করা হলো। উমাইয়াদের শরীয়ত কোনভাবেই এর সাথে মিলবে না বিধায় অনেকেরই মনে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উদয় হতে পারে। আল্লাহর ইচ্ছা হলে, এ সকল প্রশ্নের উত্তর কোরআন ভিত্তিক দেয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত।
আমরা জানি পেশাজীবী মৌলবাদীগণ বইটিতে অনুসন্ধান করার পদ্ধতিটি পছন্দ করবে না এবং কোরআনের সত্য মেনে নেবে না। কারণ ইতোপূর্বে ইহুদি এবং খ্রিস্টান মৌলবাদীগণও (সাধারণ অনুসারীগণ বাদে) কোরআনের সত্য মেনে নেয়নি। সুতরাং মুসলিম পেশাজীবী মৌলবাদীগণও তাদের পেশার স্বার্থে কোরআনের সত্য প্রত্যাখ্যান করতে পারে। এ জন্যে আমরা তাদেরকে দোষারোপ করবো না। তাদের শিক্ষার মান ও পদ্ধতিই এর জন্যে দায়ী।
মুসলিম মানসের কোরআনের অনুসারী সকল সত্যানুসন্ধানী বিশার জনগোষ্ঠীর সরল বিশ্বাস এবং সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েই আমাদের এ অনুসন্ধান প্রয়াস। এর থেকে যদি সাধারণ বিশ্বাসীদের বিশ্বাস ও এর আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকাণ্ড সঠিক মাত্রায় প্রবর্তন ঘটে, তবেই আমাদের এ কষ্টকর অনুসন্ধান সফল এবং সরল বিশ্বাসীদের বিজয় হয়েছে বলে মনে করবো।