"লোকচিকিৎসায় তন্ত্র-মন্ত্র" বইটির প্রসঙ্গ কথা অংশ থেকে নেয়াঃ মন্ত্র বাংলা লােকসাহিত্য-ভাণ্ডারের অমূল্য রত্ন বিশেষ। বাঙালী সংস্কৃতির স্বরূপ সন্ধানে মন্ত্রের ভূমিকা অপরিসীম। লােকসংস্কৃতির এই অমূল্য সম্পদের প্রতি ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক এবং লােকসাহিত্য গবেষকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়নি এখনও। জাতীয় সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞেয় মনােভাবই এর মূল কারণ। বাংলার লােকসমাজে যাদু বিশ্বাস আজও প্রবল। মন্ত্রের সঙ্গে যাদুর সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। যাদুশক্তি অর্জিত হয় মন্ত্রগুণে। প্রকৃতি ও দৈবনির্ভর জড়ােপাসক আদিবাসী সমাজে একদা যে বিশ্বাসের উদ্ভব কালক্রমে তা ব্যাপ্ত হয় বাংলার হিন্দু-মুসলমানবৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সকল লােকসমাজে। ধর্ম-বর্ণ-গােত্র শ্রেণী নির্বিশেষে আজও মন্ত্রের চর্চা অনুশীলিত হয় নানাভাবে। মন্ত্র সাহিত্য পদবাচ্য হলেও সাহিত্য গুণ এতে ততটা নেই। মন্ত্রকে সাধারণত আত্মরক্ষা ও জনকল্যাণমূলক কর্মে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর ফলে সারাদেশে মন্ত্রগুণী সমাজ নামে একটি পেশাজীবী শ্রেণী গড়ে ওঠে। লােকসমাজের নানাবিধ রােগে-শােকে আপদে-বিপদে তারা পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মন্ত্র-তন্ত্র, ঝাড়ফুক, তাবিজ-কবজ চিকিৎসার মূখ্য ভূমিকা পালন করে। বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার যুগে লােকচিকিৎসা লােকজীবনে কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম তার বিচারের দায়িত্ব আমার নয়। তবে যে চিকিৎসা পদ্ধতি লােকসমাজে সহস্রাধিক বছর যাবৎ কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে তাকে বিজ্ঞানের তুরির মুখে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এথেকেও অনেক কিছু জানবার এবং শিখবার আছে। লােকজ্ঞানকে উপেক্ষা করার শক্তি আজও বাঙালী সমাজ যথার্থভাবে অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। মন্ত্র সংগ্রহ একটি জটিল কাজ। যেসব ওঝা-কবিরাজ মন্ত্রের ধারক-বাহক তাদের চিরাচরিত বিশ্বাস মন্ত্র লােকসমাজে প্রকাশ করলে তার কার্যকারিতা খর্বিত হয়। একারণে অপরিসীম ধৈর্য ছাড়া এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করা আদৌ সম্ভব হয়না। একক প্রচেষ্টায় মন্ত্র সংগ্রহে অদ্যাবধি বাংলাদেশের কেউ উল্লেখযােগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মন্ত্র সংগ্রহে একমাত্র দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী। এই প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহের উপর ভিত্তি করে ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমী থেকে মন্ত্র নির্ভর লােকসাহিত্য সংকলনের ত্রয়ােদশ খণ্ডের প্রকাশ ঘটে। অতঃপর ড. ওয়াকিল আহমদ এই খণ্ডের মন্ত্রগুলাের সঙ্গে আরও কতিপয় মন্ত্র বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করে বাংলা লােকসাহিত্য মন্ত্র’ শীর্ষক একখানি সম্পাদকীয় গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। আধুনিক ফোকলাের চর্চার ধারায় এধরনের গবেষণার কোন মূল্য নেই। ‘লােকচিকিৎসায় তন্ত্র-মন্ত্র’ গ্রন্থের সবগুলাে মন্ত্রই সংগৃহীত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা থেকে। আমার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফোকলাের বিভাগের ৫৮ জন ছাত্র-ছাত্রীর প্রচেষ্টায় বিগত দু'বছরের ফিল্ড ওয়ার্কের একমাস সময়ে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে সহস্রাধিক মন্ত্র সংগৃহীত হয়। এদের মধ্য থেকে বিভিন্ন রােগের ৩৯৯টি মন্ত্রসহ মােট ৪৪৩ টি মন্ত্র এ গ্রন্থে স্থান পায়।