ভূমিকা পথের পাঁচালী গ্রন্থটির তিনটি পর্ব। বল্লালী বালাই, আমআঁটির ভেঁপু, অক্রূর সংবাদ। আমাদের দেশে কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন করেন রাজা বল্লাল সেন। সেই প্রথা অনুসারে এক-একজন কুলীন বহুকন্যার পাণিগ্রহণ করতেন। বৃদ্ধ কুলীনের বালিকা-বিবাহও খুব দুর্লভ ব্যাপার ছিল না। এই সব স্ত্রীদের স্বামীগৃহে বাস সম্ভব হত না। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর এঁরা সংসারে, গলগ্রহ বা বালাই স্বরূপ হয়ে থাকতেন। ইন্দির ঠাকরুন তার দৃষ্টান্ত। পথম পর্বে ইন্দির ঠাকরুন প্রধান চরিত্র বলে এই পর্বের নাম বল্লালী বালাই । শুকনো আমের আঁটির শক্ত খোলা টেনে খুলে ফেলে, তার ‘কষি’ থেকে পল্লীগ্রামের ছেলেমেয়েরা একধরনের ভেঁপু বাঁশি তৈরি করে। গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের এটি নিখরচার আনন্দ। দারিদ্র্যের মধ্যেও অপু চরিত্রের আনন্দময় বিকাশের কাহিনী মধ্যম পর্বটি। তাই এটির প্রতীকী নাম আম আঁটির ভেঁপু। অক্রূর ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পিতৃব্য। মথুরায় শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবন থেকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। অক্রূর বৃন্দাবন গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে মথুরায় নিয়ে আসেন। শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা যেমন বৃন্দাবনে অবসান, অপুর বাল্যজীবনও নিশ্চিন্দিপুর থেকে কাশীযাত্রার মধ্যেই অবস্থিত। সেইজন্যই শেষ পর্বটির নাম অক্রূর সংবাদ।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।