"নোটবুক" বইটিতে লেখা ভূমিকা: পৃথিবীর শিল্প-ইতিহাসে সর্বকালের জনপ্রিয়তম দুটি ছবি - মোনা লিসা ও লাস্ট সাপার-এর স্রষ্টা লিওনার্দো দা ভিঞ্চি শুধু চিত্রকর হিশেবেই নয়, সেইসঙ্গে ভাস্কর, স্থপতি, সঙ্গীতজ্ঞ, বিচিত্রবিদ্যায় পারঙ্গম নির্মাণকুশলী কারিগর, এমনকী জলপ্রণালীর পরিকল্পক, গণিতজ্ঞ ও সামরিক প্রযুক্তিবিদ হিশেবেও সমধিক খ্যাত ছিলেন। কিন্তু আরও বিভিন্ন বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার বর্ণনা, ফলাফল ও সিদ্ধান্ত তিনি কখনও বিচ্ছিন্ন পৃষ্ঠায়, কখনও বা বাঁধানো খাতায় পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখে রাখলেও জীবৎকালে সে সমস্ত আদৌ সর্বসাধারণের গোচরে আনেননি বরং অনধিকারীর হাতে পড়ে যাতে তার কোন কিছুর অর্থবিকৃতি বা প্রয়োগবিচ্যুতি না-ঘটে তার জন্য অতিরিক্ত সাবধানতার বশে লিখেছেন প্রচলিত রীতির বাইরে, ডানদিক থেকে বাঁদিকে, সর্বদা উল্টোছাদে অর্থাৎ স্বাভাবিক ছাঁদের হরফ আয়নায় প্রতিবিম্বিত হলে যেমন হয় সেভাবে, পাতার পর পাতা বাঁহাতের অমার্জিত রুক্ষ হস্তাক্ষরে। শব্দ-ব্যবহার ও বাক্যবিন্যাসের ক্ষেত্রেও তার স্বকীয়তা বিভ্রান্তিকর। তার উপর একই পৃষ্ঠায় একই সঙ্গে অবলীলায় তিনি বহু আপাতবিচ্ছিন্ন বিষয়ের অবতারণা করেছেন - হয়তো শুরু করলেন জ্যোতির্বিদ্যার কোন সূত্র দিয়ে, সেখান থেকে ধ্বনির নিয়ম পেরিয়ে চলে গেছেন বর্ণের সংবেদনে। আর-একটি পৃষ্ঠা হয়তো শুরু হয়েছে অন্ত্রের গঠন দিয়ে, শেষ হলো কবিতা ও ছবির আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে কোন দার্শনিক মন্তব্যযোগে। এসবের কোথাও কোন পৃষ্ঠাসংখ্যা নেই, যেখানে আছেও তার সঙ্গে বিষয়ের সঙ্গতি নেই। ফলে, পরবর্তীকালে তার স্বহস্তে লিখিত ও চিত্রিত অসংখ্য পৃষ্ঠার মধ্যে এমনকী বিচ্ছিন্ন কয়েকটিরও মালিকানালাভের জন্য সংগ্রাহকেরা হয়তো বহু অর্থব্যয় করেছেন, কিন্তু গোলকধাঁধা ভেদ করে পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাগুলিতে প্রকৃতপক্ষে কী আছে তার রহস্য নিবারণের জন্য শ্রম ও সময় ব্যয় করার তোক কার্যত অল্পই জুটেছে। সঙ্গত কারণেই তাঁর গবেষণার ব্যাপ্তি ও মৌলিকত্ব সম্পর্কে সমকালে তো বটেই, এমনকী তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী দু’তিন শতকেও কোন মহলেই কোন সম্যক ধারণা গড়ে ওঠেনি। তার মনোনীত উত্তরাধিকারীর হাত ঘুরে ততদিনে বিশৃঙ্খল পৃষ্ঠা ও খাতাগুলি পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, হয়তো তার একটা বড় অংশ চিরকালের মতো হারিয়ে বা নষ্ট-ই হয়ে গেছে। খ/ লিওনার্দো দা ভিঞ্চির নোটবুক : বিজ্ঞানের নীতি শিল্পের সূত্র অবশেষে, হস্তাক্ষর ও ভাষার প্রাথমিক বাধা কাটিয়ে অকল্পনীয় পরিশ্রমে লিওনার্দোর শেষ তিরিশ বছরের ফসল প্রায় পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার এই বিপুল রচনাসম্ভার বিষয়ানুযায়ী সাজিয়ে প্রথম প্রকাশ করেন মহাশয় জাঁ পোল রিষটার, উনিশ শতকের শেষে। বস্তুত তখনই তুঙ্গরেনেসাঁর এই মহান প্রতিভার মনশ্চিত্র কিছুটা পরিষ্কার হয়, বোঝা যায় মানবিক জ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তাঁর সৃজনী ভূমিকার স্বাক্ষর পড়েনি, জড় ও জীবনের প্রকৃতি ও ধর্মসংক্রান্ত এমন কোন শাস্ত্র নেই যা তাঁর প্রতিভার যাদুছোঁয়ায় উদ্ভাসিত হয়নি। শিল্প ও বিজ্ঞানের মতো মানবিক সৃজনশীলতার আপাতবিচ্ছিন্ন দুটি শাখার সমন্বয়সাধক হিশেবেও তিনি স্মরণীয়, পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় দেখা যায় নানান সূত্রে বারবার তিনি বলছেন যে জ্ঞানই শিল্পের ভিত্তি, প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ছাড়া শিল্পের চর্চা অসম্ভব, আগ্রহে ও কর্মে, পর্যবেক্ষণে ও বিবেচনায় শিল্পীকে হতে হবে ব্রহ্মাণ্ডজ্ঞানী স্বয়ং লিওনার্দো নিঃসন্দেহে তার নিজের ক্ষেত্রে অন্তত সে দাবি পূরণ করেছিলেন। বাংলায় প্রকাশের সময় আমরা বিষটার-সম্পাদিত লিওনার্দো দা ভিঞ্চির রচনাসমগ্রই হুবহু অনুসরণ করেছি কিন্তু, আপাতত তার মধ্যে শুধু প্রত্যক্ষভাবে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রচনাংশই দুখণ্ডে প্রকাশ করার কথা ভেবেছি। আলােচিত বিষয়ের কথা ভেবে ‘বিজ্ঞানের নীতি শিল্পের সূত্র’ -- এই নামও আমরা দিয়েছি। এ খণ্ডে সংশ্লিষ্ট কোন ছবি বাদ দেওয়া হয়নি, এমনকী এই সঙ্গে মূল পাণ্ডুলিপির আটটি পৃষ্ঠার নমুনাও মুদ্রিত হয়েছে। জর্জিও ভাসারি-প্রণীত লিওনার্দোর সুবিখ্যাত জীবনচরিতটিও গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যদিও তার ধ্রুপদী বর্ণনার ভাষা সর্বত্র রক্ষা করা যায়নি বলে মূলানুগ অনুবাদ বলা তাকে ঠিক হবে না।। এই কঠিন অনুবাদকর্মের শুরুতে ছিল শ্রীযুক্ত সলিল সাহার উৎসাহ, কাজ চলাকালীন নানাভাবে প্রচুর সাহায্য করেছেন অলকানন্দা সেনগুপ্ত, হরফসজ্জা ও রেখাচিত্র অঙ্কনের পর্ব প্রায় একাই সামলেছেন পিন্টু চ্যাটার্জী। অন্তরঙ্গতার কারণে এঁদের কাউকেই বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানানোর মানে নেই। ভুল-ত্রুটির যাবতীয় দায়িত্ব শুধু আমার, যথাযোগ্যভাবে তা জ্ঞাপিত হলে বাধিত হব।