ভূমিকা রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের পূর্বে বঙ্গ-সাহিত্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শ এবং শিক্ষাদীক্ষার সদ্যোমিলন ঘটিয়াছিল। সে মিলন তখন সর্বাঙ্গীণ হইয়া উঠে নাই, সত্য হইয়া উঠে নাই, তাহার সহিত জাতীয় জীবনের সম্পূর্ণ সংযোগও ঘটে নাই। যাহা কিছু পাশ্চাত্য তাহাকে সহজেই বাছিয়া বাহির করা যাইত। জাতীয় জীবনসাগর আতল আলোড়িত হইয়াছিল বটে কিন্তু জাতির নিজস্ব প্রাণলক্ষ্মীর উদবোধন হয় নাই । সাহিত্যে জাতীয় গৌরবের কথা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিলেই এবং বিষয়বস্তু ও উপকরণ স্বদেশীয় হইলেই কোনো সাহিত্য জাতীয় সাহিত্য হইয়া উঠে না। জাতীয় জীবনের সহিত তাহার যোগ থাকা চাই, জাতির অন্তর্জীবনের নিগূঢ় সুখদুঃখ তাহাতে বিম্বিত হওয়া চাই, জাতির উপরিতলে যে সমাজটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত হইয়াছিল, তাহার কথাই সমগ্র জাতির প্রাণের গভীর বাণী তাহাতে ধ্বনিত হওয়া চাই। বিদেশি শিক্ষাদীক্ষার ফলে জাতির উপরিতলে যে সমাজটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত হইয়াছিল, তাহার কথা সমগ্র জাতির কথা নয় । পৌরাণিক উপাখ্যান বা রাজপুতজাতির শৌর্যকাহিনির মধ্যে জাতির প্রাণের বার্তা পাওয়া যায় না। এই হিসাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যকে সম্পূর্ণ জাতীয় সাহিত্য বলা যায় না। অবশ্য এ কথাও বলিতে হয়, বঙ্কিমের হাতেই জাতীয় সাহিত্যরচনার ওই সূত্রপাত হইয়াছিল। রবীন্দ্রপূর্ব যুগের সাহিত্য প্রধানত বস্তুতান্ত্রিক। এই যুগের সাহিত্যে আত্মবিশ্লেষণের বা অন্তরন্বেষণের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় না। বহির্জগতের প্রেরণায় সাহিত্যিকদের হৃদয় বিগলিত হইয়াছে, অন্তরের উৎসমুখ তখনও মুক্ত হয় নাই। এই যুগের সাহিত্যে হৃদয়াবেগের অভাব ছিল না; কিন্তু যে সংযম প্রয়োগ করিলে হৃদয়াবেগ রসমূর্ত হয়, সে সংযম অধিকাংশ সাহিত্যিকের ছিল না। হৃদয়াবেগের উচ্ছলিত উৎসারণকেই অনেকে সৎ-সাহিত্য মনে করিয়াছেন। হৃদয়াবেগ অনেক সময় ভাবাকুলতায় পরিণত হইয়াছে, তাহা ধর্মের পক্ষে যতটা অনুকূল, রসের পক্ষে ততটা নয়। এই যুগের সাহিত্যে বিদেশ হইতে আহৃত রাশিরাশি চিন্তা ও ভাবকে ভাষায় প্রকাশ করিবার একটা উৎসাহ দেখা যায়। অভিনব চিন্তাগুলিকে সাহিত্যের পুটে পরিবেশন করিবার অত্যাগ্রহে সাহিত্যিকরা প্রকাশসৌষ্ঠবের দিকে মনোযোগী হন নাই অর্থাৎ বহু কথা শুনাইবার যতটা তাঁহাদের আগ্রহ ছিল, রসসৃষ্টির দিকে ততটা আগ্রহ ছিল না। প্রকাশ-সৌষ্ঠবটাই যে সৎ-সাহিত্যের প্রধান অঙ্গ, টেকনিকের সর্বাঙ্গসুন্দরতার উপর যে সাহিত্যের মর্যাদা নির্ভর করে—বঙ্কিম ছাড়া তাহা কেহ বড়ো বুঝিতেন না। তাই কি গদ্যে, কি পদ্যে তাঁহারা তাড়াতাড়ি একটা কিছু গঠন করিতে পারিতেন কিন্তু গঠনের সৌষ্ঠব ও কলাশ্রীর দিকে ততটা মনোযোগী হইতেন না। তাঁহারা ভিত্তি দৃঢ় করিতে চেষ্টা করিতেন, বহু উপকরণ কাজে লাগাইতেন কিন্তু শোভনশ্রী দান করিতে পারিতেন না। অবশ্য ভিত্তি দৃঢ় ছিল বলিয়াই ওই সাহিত্য এখনও টিকিয়া আছে কিন্তু সুমার অভাবে উপভোগ্য হইতে পারিতেছে না ।