ভূমিকা বাংলার কালজয়ী বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধাকৃষ্ণের মাধুর্যঘন লীলা-বৈচিত্র্য বাঙ্ময় রসরূপ লাভ করেছে। আত্মভাবনালীন গীতিকবিতার লক্ষণাক্রান্ত, মন্ময়তামূলক বৈস্নব পদসাহিত্য শুধুমাত্র শিল্পরসাস্বাদনের মানদণ্ডে বিচার্য নয়, এর সঙ্গে যে বিশেষ ধরণের জীবন-চেতনা ও পারমার্থিক সাধনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, সেই রসাশ্রয়ী চিৎপ্রকর্ষের অন্তরঙ্গ সাধনার ধারাবাহিকতা নিরূপণের চেষ্টা করা হয়েছে এই গ্রন্থে। বৈঘ্নবধর্মের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের তাত্ত্বিক অনুধাবনের জন্য এর ঐতিহাসিক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপটের পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন বিবেচনা করা হয়েছে। বৈদিক সংহিতা ও উপনিষদের কাল থেকে ভারতবর্ষের উর্বর মনোভূমিতে ভক্তিধর্মের বীজ উপ্ত এবং বর্ধিত হয়ে গীতা ও ভাগবতে বিশাল বনস্পতির রূপ ধারণ করেছে। বৈঘ্নব রসতত্ত্ব অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ অখিলরসামৃতসিন্ধু, আনন্দ-চিন্ময় লীলাপুরুষোত্তমবিগ্রহ, এবং রাধা হলেন তাঁর হ্লাদিনীশক্তির পূর্ণ প্রকাশ। গৌড়ীয় বৈষ্ণব বেদান্তের অচিন্ত্যভেদাভেদবাদে জীব কৃষ্ণের তটস্থা শক্তি, জীবের পরম পুরুষার্থ অপ্রাকৃত কৃষ্ণপ্রেমসুখ। কৃষ্ণরতির মাধুর্যরসৈকপ্রবণতা সুবিদিত। লীলারসাত্মক বৈষ্ণব পদাবলীর বিভিন্ন রস-পর্যায়ের তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে এই গ্রন্থে মধুররতির আস্বাদন-চমৎকারিত্ব বোঝানোর যৎকিঞ্চিৎ চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলার প্রাক্-চৈতন্য ও উত্তর-চৈতন্য যুগের পদাবলীর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে কীভাবে রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত শ্রীচৈতন্যদেবের দিব্য জীবনবিভায় বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছে এবং কীভাবে পদাবলী-সাহিত্য পুষ্পিত হয়ে উঠেছে গৌরপ্রেমমাধুর্যের রসসিঞ্চনে। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস ও জ্ঞানদাসের পদে শাশ্বত প্রেম-সত্যের গভীরতম উচ্চারণ বিধৃত হয়ে আছে। প্রত্যক্ষ-দৃষ্ট জীবনের নিতান্ত মানবিক অনুভবের মর্মমূলে যে অনির্বচনীয়তার সুরভি আছে, তাকে তাঁরা প্রগাঢ় উপলব্ধি-তন্ময়তায় পরিস্রুত করে এক ইন্দ্রিয়াতীত ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছেন। মানবিক জীবন-তৃষ্ণার মধ্যে কীভাবে দেহোত্তীর্ণ প্রেমের স্বরূপসন্ধান করেছে বৈয়ব পদাবলী, সেই আলোচনায় প্রয়াসী এই গ্রন্থখানি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের এবং অন্যান্য জিজ্ঞাসু পাঠকের কৌতূহল চরিতার্থ করবে।