উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির চেতনা যখন প্রলম্বিত সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বলয় থেকে বেরিয়ে এসে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও সৃষ্টি-ভাবনায় নতুন ভাবে জেগে উঠছিল, ঐতিহাসিক সেই সন্ধিক্ষণে জন্ম নিয়েছিল বাংলা ছোটগল্প। রবীন্দ্রনাথ এই নতুন শিল্প-চেতনারও পথিকৃৎ। বিশ শতকে তাঁর মহীরূহতুল্য উপস্থিতিকে প্রণিপাত জানিয়েও তরুণ কথাকারেরা নতুন সৃষ্টির পথ আবিষ্কার করে নিচ্ছিলেন। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে যে নতুন চেতনা-তরঙ্গ উদ্বেল হয়ে উঠেছিল, পরবর্তী প্রতিটি দশকে তা আরও প্রসারিত হল । ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে যত ভাঙচুর ও জটিলতা দেখা গেল, সেইসব পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মের গল্পকারদের নতুন দিশার সন্ধানে প্রাণিত করেছে। যে নবীন শিল্প-মাধ্যম একদা কাহিনির বিন্দুতে উপলব্ধির সিন্ধু খুঁজে নিচ্ছিল, তা-ই ক্রমশ কাহিনির কাছে আনুগত্য আর প্রকাশ করতে চাইল না। এমনকি, মরীচিকা বলেও ঘোষিত হল কাহিনি। এল আমূল বিনির্মাণ, গল্পহীন গল্পরচনার প্রবণতা। সব মিলিয়ে ছোটগল্পের প্রতিবেদন অভাবনীয় রূপান্তরের স্মারক এখন। বাংলা ছোটগল্পে এই আশ্চর্য রূপান্তরের বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হল এই বইয়ের দ্যুতিময় প্রবন্ধগুলিতে। সময় ও পরিসরের যুগলবন্দি কীভাবে প্রতিবেদনের সংরূপ ও স্বভাব পাল্টে দিয়েছে, তারই মনন-দীপ্ত উপস্থাপনা পাঠকেরা প্রবন্ধগুলিতে খুঁজে পাবেন ।
এ-সময়ের পুরোধা সাহিত্যিতাত্তিক ও সমালোচক তপোধীর ভট্টাচার্য (জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯) বাংলা সাহিত্যের যশস্বী চিন্তাবিদ। বাঙালির নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব হিসেবে উত্তর আধুনিক চেতনার অন্যতম প্রস্তাবক তিনি। এখনও পর্যন্ত তাঁর ১৩৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘তুমি সেই পীড়িত কুসুম’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। মোট ৩২ টি কবিতা-সংকলন তাঁর রয়েছে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কার্যদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। এছাড়া দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাবান রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করছেন। ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এমেরিটাস অধ্যাপকও। নিরন্তর মনন-চৰ্চা করাই তাঁর জীবনের ব্রত। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : প্রতীচ্যের সাহিত্যতত্ত্ব, ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ, আধুনিকতা : পর্ব থেকে পর্বান্তর, বাখতিন তত্ত্ব ও প্রয়োগ, ছোটগল্পের সুলুক-সন্ধান, উপন্যাসের সময়, উপন্যাসের বিনির্মাণ, কবিতার রূপান্তর, কবিতা : নন্দন ও সময় প্রভৃতি।