"কলকাতা শাসনের জার্নাল" বইটির নতুন সংস্করণের ভূমিকাঃ আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে, আমার লেখক জীবনের শুরুর দিকে যখন গদ্যরচনায় হাতে-খড়ি হচ্ছে, সেই সময়ে ত্রিশঙ্কু ছদ্মনামে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক আলোয় কালোয় লিখেছিলাম। এক বছর। গোটা পঞ্চাশেক রম্যরচনা। বা, আমাদের বোহেমিয়ান জীবনের কিছু স্মৃতিচারণ। দেশ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক সাগরময় ঘোষের প্ররোচনায় এইসব গদ্য লেখার সূত্রপাত। হাতের আড় ভাঙে এর আগে কেবল কবিতা লিখেছি আর কবিতা বিষয়ক কিছু গদ্য। সাগরবাবু বললেন। তোমায় ফিকশন লিখতে হবে। ফিশন না লিখলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। ওঁরও স্বার্থ ছিল। নতুন নতুন মশলা দিয়ে সাপ্তাহিক পত্রিকার পাতা ভরানো। সারা জীবন বহুত পরিশ্রম করে উনি বহু গাধাকে পিটিয়ে ঘোড়া করেছেন। সেই রচনাগুলি থেকে বেছে কয়েকটি লেখা নিয়ে এই আলোয় কালোয় নামের বই। প্রকাশক হীরক রায়। এখন তিনি কোথায় আছেন বা জীবিত আছেন কিনা জানি না। তার পরিচিত ঠিকানায় অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেছিলাম। সে-চিঠি ফেরত এসেছে। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। | তিনি প্রয়াত। স্কেচ করেছিলেন সুধীর মৈত্র। তিনিও প্রয়াত। সাগরবাবুও ইহলোকে নেই, কিন্তু দেশ পত্রিকা চলছে। নতুন সম্পাদক ভালো-ভালো লেখা সংগ্রহ করতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত আর, লেখক আমি বেঁচে আছি। সেই সময় এই রচনাগুলি তেমন জনপ্রিয় হয়নি বিষয় বৈচিত্র্যের কারণে। যেসব বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে, তা বাস্তব সত্য হলেও, আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে তা আলোচিত হত না প্রকাশিত হত না। সেই প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষার খাতিরে পাবলিক নোটিশে আনা হল পাঠকের রুচির কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হল। আজ পঁয়ত্রিশ বছর পর বইটির আবার খোঁজ পড়েছে দেখে নতুন প্রকাশক এগিয়ে এসে বইটি আবার ছাপছেন। আজকের পাঠক জীবনের গোপন স্তরের কথাবার্তা পড়তে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। সহনশীল হয়েছেন অন্যান্য ভাষার সাহিত্যেও খোলাখুলি কথা বলার অভ্যেস প্রচলিত হয়েছে। লেখককে এখন আর ছাপোশ গৃহস্থের ভাবমূর্তি নিয়ে সমাজে ঘুরতে হয় না। মেয়েদের অন্তর জীবনের কথা মেয়েরাই লিখছেন এখন। নতুন সংস্করণ ছাপতে গিয়ে ছদ্মনামী লেখক স্বনামেই পরিচিত হচ্ছেন। বইটির নাম বদলে কলকাতা শাসনের জার্নাল’ করা হল কেন না লেখকের বোহেমিয়ান জীবনে রচিত কবিতার প্রথম লাইন—“রাত বারোটার পর কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক’—এখন পাঠকের মুখে মুখে ঘোরে। ওই ছবিটা—চারজন বেপরোয়া যুবক ঘোড়ায় চড়ে মধ্যরাত্রির কলকাতা শহর শাসন করছে উত্তর থেকে দক্ষিণে আর গৃহস্থেরা তাদের গোড়ার খুরের টগবগ শব্দ শুনছে মশারির ভেতর শুয়ে—যাকে বলে, খেয়েছে। লোকে জিজ্ঞেস করছে, ওই চারজন কারা তাদের নাম কী। তারা কলকাতার পেটের মধ্যে ঢুকে কী দেখছে। তখনকার দিনে আমি বা আমরা বন্ধুবান্ধব কলকাতার অলিতেগলিতে নিষিদ্ধ পল্লিতে শ্মশানে মদের ঠেক-এ যেসব মানুষের দেখা পেয়েছিলাম, তারা কেউ জন্মগতভাবে খারাপ লোক নয়। আমাদের বিশ্বাস হয়েছিল, মানুষ সৎ এবং সুভদ্র হয়েই জন্মায়, তারপর পরিবেশ পরিজন তাকে গড়ে পিঠে বড়ো করে তোলে। অভাব, দুর্ভোগ, দুর্নীতি, অপচয়, শ্রেণিবৈষম্য তার চরিত্রকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। হয়তো সামাজিক অপরাধীতে পরিণত হয় কেউ কেউ, কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ পেলে তারা নষ্ট হত না। তবে, পঁয়ত্রিশ বছর আগের তুলনায় কলকাতা শহর এখন অনেক বেশি নিষ্ঠুর। হৃদয়হীন ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে গেছে। অনেক নোংরা জঞ্জালে ভরা, দূষিত আর ভিড়ে ঠাসা হয়ে গেছে। আমরা নিমতলা শ্মশানে গিয়ে যে ফুরফুরে বাতাসে মড়া-পোড়ার গন্ধ পেতাম, যে-রকম আরামে সন্ন্যাসীর ধুনির সামনে বাবু হয়ে বসতে পারতাম, এখন সে সুখ আর নেই। আজকের দিন হলে সেই সময়ে আমরা কেউ কেউ খুন হয়ে যেতে পারতাম। | পাঁচ ছয় বছর অনিয়মিত জীবনযাপন করার পর আমরা একে একে গৃহস্থ হয়ে গেছি। সেই অনিয়মিত জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে কিছু লেখালেখি করেছি পরে। আমার কিছু কবিতা আর এই আলোয় কালোয় রচনা তার মধ্যে পড়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন অরণ্যের দিনরাত্রি' নামের উপন্যাস, যা নিয়ে সত্যজিৎ রায় ছবি করেছেন, আর ‘স্মৃতির শহর’ দীর্ঘ কবিতা। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় কিছু গল্প-টল্প। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার আমুদে বিষ আমাদের সকলের লেখায় ঢুকে গেছে। কলকাতা শাসনের জার্নাল’ সেই বিষের একটি ক্ষুদ্র ভাণ্ড। কলকাতা, ২১ ডিসেম্বর ২০০৮
১৯৩১ সালে পুরী শহরে জন্ম কবি Sharotkumar Mukhopaddhay-এর। সাহিত্যচর্চা শুরু করেন কবিতা দিয়ে। কবিতার পাশাপাশি বাংলা গদ্য সাহিত্যেও রয়েছে তাঁর বিশেষ অবদান গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে তুমুল হই চই ফেলে দেওয়া কৃত্তিবাস পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। উচ্চতর শিক্ষা বিদেশে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড়ো-বড়ো পদে চাকরি করার পর ৫২ বছর বয়সে নিয়েছেন স্বেচ্ছাঅবসর। বর্তমানে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেছেন লেখালেখিতে। কবিতার জন্য এবছরই পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। কবিতার সূত্রেই পাঠকমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছেন কবি শরৎকুমার। লেখকের বোহেমিয়ান জীবনে রচিত কবিতার প্রথম লাইন, ‘রাত বারোটার পর কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক। এই জনপ্রিয় লাইনের অনুষঙ্গ ধরেই তাঁর বোহেমিয়ান জীবনে লেখা অসামান্য গদ্যগুলির নামকরণ করা হয়েছে কলকাতা শাসনের জার্নাল'। লেখকের নিজস্ব ভাষায়, “পাঁচ ছয় বছর অনিয়মিত জীবন যাপন করার পর আমরা একে একে গৃহস্থ হয়েছি। সেই অনিয়মিত জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে কিছু লেখালেখি করেছি পরে। আমার কিছু কবিতা আর এই আলোয় কালোয় রচনা তার মধ্যে পড়ে। সরস ভঙ্গিমায় লেখা গদ্যগুলির মধ্যে কলকাতা শহরের হৃৎস্পন্দন অনুভব করা যায়।