ভূমিকা এক জটিল সময়ের আবর্তে উঠে এসেছে কবি ভারতচন্দ্র এবং তাঁর অন্নদামঙ্গল । একদিকে একটি যুগের অবসান, অন্যদিকে আর এক যুগের আগমন। সুদৃঢ় মোগল শাসনের ভিত্তি টলে গিয়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে ইংরেজ অধিকারের সূচনা পর্ব। যুগের এই উলট্ পুরাণে স্বভাবতই মানসিক জটিলতায় আবদ্ধ হয়েছেন কবি। সার্বিক সংকটের কালে সঙ্গত কারণেই দেশকালের ছাপ কাব্যে পড়েছে। পুরনো মূল্যবোধের ভূমিতে ধ্বনিত হয়েছে নতুন ঊষার কল- কাকলি ৷ দেবসমাজের উপর থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে এনে সাধারণ মানুষের উপর তাকে বসিয়ে ভারতচন্দ্র এক অনাস্বাদিত পূর্ব আধুনিকতার সূচনা করলেন। কবিসৃষ্ট অন্নদামঙ্গলে সেজন্য দেবতার জায়গায় মানুষের জয় ঘোষিত হয়েছে। ভক্তিতে কবি একেবারেই গদগদ হননি । ভক্তির স্থানে ধরা পড়েছে যুক্তি। তাই দেবদেবীর শরীরে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে ধুলো-বালি । অন্নদামঙ্গলে আধুনিকতার এক অস্ফুট পদসঞ্চার ঘটেছে। দৈব নির্ভরতার জায়গায় আত্মনির্ভরতা, স্বচ্ছ জীবনদৃষ্টি, মানবজীবনবোধের উষ্ণতা, বুদ্ধির আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ কাব্যে সর্বপ্রথম সূচিত হয়েছে। সেজন্য শুধু ‘রাজকন্ঠের মণিমালা' ভূষণে কবিপ্রতিভাকে যেন অস্বীকার করা হয়। মণিমালার আশ্রয়স্থল গোপন কক্ষ। কিন্তু অন্নদামঙ্গল সে কক্ষে বন্দি না হয়ে মুক্ত প্রাঙ্গণে গণকন্ঠে দোলায়িত হয়ে চলেছে। রায়গুণাকরের কাব্য সম্পর্কে পণ্ডিতমহল ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছেন। সেখানে কবির ভাগ্যে একই সঙ্গে জুটেছে নিন্দা ও স্তুতি। এমন বিতর্ক মধ্যযুগের অন্য কোনো কবিকে নিয়ে আর হয়নি। কিন্তু বিতর্কের মধ্যেও যে সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মধ্যযুগের সাহিত্য মানেই ঢিলেঢালা, হাইতোলা, আড়িমোড়া ভাঙা নয়। আলোচ্য গ্রন্থে আমাদের মধ্যযুগীয় বদ্ধ ভাবনাকে সরিয়ে রাখার পাশাপাশি ভারত-বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে যুগন্ধর শিল্পীর শিল্পী-সত্তাকেই পাঠক সমাজে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
ড. ভবেশ মজুমদার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন যথাক্রমে হাজার ১৯৯৫ ও ১৯৯৭ সালে। উভয় ক্ষেত্রেই প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য মূলত তার আগ্রহের জায়গায়। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক তাপস বসুর তত্ত্বাবধানে মঙ্গলকাব্য-গবেষণা করেছেন।সুধীজন কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে তার "মঙ্গলকাব্য আর্য-অনার্য সংস্কৃতি সমন্বয়" গবেষণা কর্মটি। লোকসংস্কৃতির প্রতিও রয়েছে তার সমান ভালবাসা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি অর্থানুকূল্যে "গাছি সম্প্রদায় জীবন ও সংস্কৃতি" শিরোনামে অনু-গবেষণা করেছেন। বর্তমানে সুধিরঞ্জন লাহিড়ী মহাবিদ্যালয়ে (মাজদিয়া) সহযোগী অধ্যাপক পদে কর্মরত।