ভূমিকা ১।এই গাথাসমূহের সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে ১৯১৩ খৃঃ অব্দে মৈমনসিংহ জেলার 'সৌরভ' পত্রিকায় শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দে প্রাচীন মহিলাকবি চন্দ্রাবতীর সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত করেন। গ্রন্থকার চন্দ্রাবতীর কাহিনীর মর্থাংশটি মাত্র দিয়াছিলেন। কিন্তু যেটুকু দিয়াছিলেন, তাহা একেবারে চৈত-বৈশাখী বাগানের ফুলের গন্ধে ভরপুর; সেই দিন কেনারামের উপাখ্যানের সারাংশের উপর আমার অনেক চোখের জল পড়িয়াছিল। এই চন্দ্রকুমার দে কে এবং কেনারামের কবিতাটিই বা আমি কোথায় পাই, এই হইল আমার চিন্তার বিষয়। 'সৌরভ' সম্পাদক শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মজুমদার মহাশয় আমার পুরাতন বন্ধু। আমি চন্দ্রকুমারের সম্বন্ধে তাঁহাকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, চন্দ্রকুমার একটি দরিদ্র যুবক, ভাল লেখাপড়া শিখিতে পারেন নাই কিন্তু নিজের চেষ্টায় বাঙ্গালা লিখিতে শিখিয়াছেন। আরও শুনিলাম, তাঁহার মস্তিষ্ক বিকৃতি হইয়াছে এবং তিনি একেবারে কাজের বাহিরে গিয়াছেন। এই ছড়াটির কথা চন্দ্রকুমার এমনই মনোজ্ঞ ভাষায় লিখিয়াছিলেন যে, উহাতে আমি তাঁহার পল্লী-কবিতার প্রতি উচ্ছ্বসিত ভালবাসার যথেষ্ট পরিচয় পাইয়াছিলাম। আমি মৈমনসিংহের অনেক লোকের নিকটে জিজ্ঞাসা করিলাম কিন্তু কেহই তথাকার পল্লীগাথার আর কোন সংবাদ দিতে পারিলেন না। কেহ কেহ ইংরাজী শিক্ষার দর্পে উপেক্ষা করিয়া বলিলেন, "ছোটলোকেরা, বিশেষতঃ মুসলমানেরা, ঐ সকল মাথামুণ্ডু গাহিয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙ্গলের উপর বাহুভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কি খাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজ তৎপ্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন? আপনি এই ছেঁড়া পুঁথি ঘাঁটা দিন কয়েকের জন্য ছাড়িয়া দিন।" কিন্তু আমি কোন অজানিত শুভ মুহূর্তের প্রতীক্ষায় রহিলাম। কোন্ দিন পল্লীদেবতা আমার উপর তাঁহার অনুগ্রহ-হাস্য বিতরণ করিবেন এবং কবে তাঁহার কূপাকটাক্ষে মৈমনসিংহের এই অনাবিষ্কৃত রত্নখনির সন্ধান পাইব-ইহাই আমার আরাধনার বিষয় হইল। ইহার দুই বৎসর পরে, হঠাৎ একদিন কেদারবাবুর চিঠি পাইলাম। তিনি লিখিলেন, -চন্দ্রকুমার অনেকটা ভাল হইয়াছেন এবং শীঘ্র কলিকাতায় আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করিবেন। তাঁহার আরও চিকিৎসার দরকার। স্ত্রীর দুই-একখানি রৌপ্যের অলঙ্কার ছিল, তাহাই বিক্রয় করিয়া চন্দ্রকুমার পাথেয় সংগ্রহ করিলেন এবং ১৯১৯ সনে পূজার কিছু পূর্ব্বে বেহালায় আসিয়া আমাকে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলেন। রোগে-দুঃখে জীর্ণ, মুখ পাণ্ডুবর্ণ, অর্ভাশনে-অনশনে বিশীর্ণ, ত্রিশ বৎসর বয়স্ক যুবক, অতি অল্পভাষী তিনি পল্লীজীবনের যে কাহিনী শুনাইলেন ও
(১৮৬৬-১৯৩৯) ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা জেলার বগজুরী গ্রামে জন্ম নেন দীনেশচন্দ্র সেন। ব্রাহ্ম-বিশ্বাস অনুসারী শিক্ষক-উকিল ঈশ্বরচন্দ্র সেন ও সনাতন ধর্মাবলম্বী রূপলতা দেবীর সন্তান ছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকে বাংলা ভাষা ওসাহিত্যের গবেষণায় তিনি সাধক হয়ে ওঠেন। ঢাকার বিভিন্ন স্কুল ও ঢাকা কলেজে অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি এন্ট্রান্স ও এফ. এ. (ইন্টারমিডিয়েট) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট ছাত্ররূপে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। তিনি হবিগজ্ঞ হাইস্কুল, কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইনস্টিটিউশন ও ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার নিযুক্ত হন এবং পরের বছরই তিনি সিনেট সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ১৯১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলাে নিযুক্ত হন। ১৯২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে অভিষিক্ত হন। পরের বছর তাঁকে ডি. লিট. (ডক্টর অব লিটারেচার) উপাধি দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই পণ্ডিত অসম্ভব নিষ্ঠাবান শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাঁর মতাে মানবপ্রেমী সমাজে দুর্লভ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরেক দিকপাল কবি জসীম উদ্দীনকে দীনেশচন্দ্র সেনের পিতৃতুল্য অভিভাবকত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। পূর্ব বাংলার প্রাচীন গীতিকবিতা (পুঁথি) সংগ্রহে বিশেষভাবে ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহে কবি জসীম। উদদীন কাজে লাগিয়েছিলেন। বাংলার প্রাচীন পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনায় দীনেশচন্দ্র সেন বিশাল ভূমিকা রেখে গেছেন। বাংলা ও ইংরেজিতে কাব্যগ্রন্থ, ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগ্রন্থ সব মিলিয়ে তাঁর সত্তরখানা অত্যন্ত মূল্যবান বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ময়মনসিংহ গীতিকা ইংরেজী ও ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করান এবং নিজে ইংরেজীতে ‘History of Bengali Language and Literature' পুস্তক রচনা করেন; এই বইটি রবীন্দ্রনাথের নােবেল প্রাইজ পাওয়ার পথ সুগম করে। ৭৫ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন ইহলােক ত্যাগ করেন।