রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বহুমুখী প্রতিভার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কবিতা তাঁর প্রথম প্রেম হলেও, সুনীলের গদ্যরচনা একমাত্র মহাসমুদ্রের সঙ্গেই তুলনীয়। কারণ তা অন্তহীন, অনিঃশেষ, বাংলা সাহিত্যের পরিসরকে নিজের বিপুলায়তন নিয়ে পরিপূর্ণ করে রেখেছেন। নানা ধরণের গদ্য লিখেছেন সুনীল। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ, রম্যরচনা, আত্মজীবনী ইত্যাদি ছাড়াও তার নানা বিষয়ে লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ-ফিচারের সংখ্যাও প্রচুর। পাঠক হিসাবেও তিনি বিশ্ব-পর্যটক। দেশবিদেশের গদ্যগ্রন্থ পাঠ করেছেন তিনি। বাংলা গদ্যগ্রন্থগুলি সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে নিজের মতামত জানিয়েছেন। গদ্যসাহিত্য নিয়ে অবিরাম ভাবনাচিন্তা করে গেছেন। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই মৌলিকতায়, ঝুঁকি নেওয়ার সাহসে এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতায় তিনি চমকে দিয়েছেন সবাইকে। ভাবনাচিন্তার ক্ষেত্রে নতুন নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন। সুনীলের রচনা পাঠ করলে তাই বহুবার পড়া কোনও গ্রন্থ বা গ্রন্থকার সম্পর্কেও নতুন করে কৌহুল জেগে ওঠে। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের পুনরাবিষ্কার করার আনন্দ পাওয়া যায়। সুনীলের সারা জীবনের গদ্যসাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা এই প্রথম দুই মলাটের মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা হলাে। দেশবিদেশের গদ্যসাহিত্য সম্পর্কেযুগপৎ এটি একটি ধ্রুপদী ও আভা-গার্দ পাঠ-অভিজ্ঞতার জন্ম দেবে, এই বিশ্বসেই এই গ্রন্থের পরিকল্পনা।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।