বিপুল কবিতারচনার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি উপন্যাস ও বেশ কিছু ছোটোগল্প লিখেছিলেন জীবনানন্দ- পরবর্তী বাংলা কবিতার অবিসংবাদিত নায়ক শক্তি চট্টোপাধ্যায়। জীবনানন্দের মতোই তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলিও অন্যরকম, নির্মাণের রীতি-প্রকরণ অগ্রাহ্য করে লেখা। ‘মৃতের সহিত সাক্ষাৎকার’, ‘উটের গ্রীবা’, ‘বস্ত্রে বৈরাগীর রং’, ‘অবজারভেটরি', ‘হলুদপোড়া’—এরকম অদ্ভুত নামের সব গল্প থেকে সহজেই অনুমান হয় এ হল কবির গল্প। ‘গল্প আমি যখন যেমন- তেমন লিখতে পারি না। ব্যাপারটা আমার পদ্য লেখার মতন, ভেতরে গুরুগুরু করে মেঘ তারপর বৃষ্টি হয়।' —বলেছিলেন শক্তি, আরও বলেছিলেন ‘আমি একটু তেরচাভাবে দেখি, যতটুকু লাগে ততটুকু নিই। বেশি কথাবার্তার মধ্যে যাই না। বিষয়গুলো প্রায় পদ্যের পড়োশি তাকে প্রয়োজন মত গল্পাকার দেওয়া। কেউ যদি তাদের গল্প না বলেন তো আমার কিছুই করার নেই।' যেমন, ‘বস্ত্রে বৈরাগীর রং’ গল্পের একটুখানি ‘আকাশ তোলপাড় করে রোদ উঠেছে। রোদের যেন কাঁটা নেই, নখ নেই, বেঁধে না, গেঁথে না। জাড় জবর। হেতমপুরের বাদা ভুঁয়ে বনভোজনের গন্ধ-বাস পাচ্ছি যেন!” ‘মৃতের সহিত সাক্ষাৎকার'-এ অধ্যাপিকা স্বপ্না ও তপনের প্রেম। কিন্তু প্রেম শেষপর্যন্ত বিয়ের পিঁড়ি অবধি পৌঁছোয় না। সংসারের আর্থিক দায়দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে স্বপ্নার সময় চলে যায়। আত্মহত্যা করে তপন। স্বপ্নার স্বগত কথাবার্তা দিয়ে গল্পের শুরু, স্বগত কথাবার্তাতেই গল্পের শেষ। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে সঠিকভাবে ও সম্পূর্ণভাবে বোঝার জন্য গল্পগুলি পড়তেই হবে। গল্প-সংকলনের গুরুত্ব এখানেই।
জন্ম: নভেম্বর ২৫, ১৯৩৪ সালে জীবনানন্দ-উত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান আধুনিক কবি। বাঙালি-ভারতীয় এই কবি বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশেষভাবে পরিচিত এবং আলোচিত ছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ এর জয়নগর - মজিলপুরের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বামানাথ চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার কাশিমবাজার স্কুলে পড়তেন। দারিদ্রের কারণে তিনি স্নাতক পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়েন এবং সাহিত্যকে জীবিকা করার উদ্দেশ্যে উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন। কলেজজীবনে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। প্রথম উপন্যাস লেখেন কুয়োতলা। কিন্তু কলেজ - জীবনের বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বনাঞ্চল - কুটির চাইবাসায় আড়াই বছর থাকার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একজন সফল লিরিকাল কবিতে পরিণত হন। একই দিনে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলার অভ্যাস গড়ে ফেলেন তিনি। শক্তি নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য। ভারবি প্রকাশনায় কাজ করার সূত্রে তার শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজ বের হয়। পঞ্চাশের দশকে কবিদের মুখপত্র কৃত্তিবাস পত্রিকার অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার উপন্যাস অবনী বাড়ি আছো? দাঁড়াবার জায়গা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। রূপচাঁদ পক্ষী ছদ্মনামে অনেক ফিচার লিখেছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম, হে নৈশব্দ' ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় দেবকুমার বসুর চেষ্টায়। ১৯৭০ - ১৯৯৪ আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেছেন। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলন - এর জনক মনে করা হয় তাঁদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম । সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার সহ তিনি একাধিক পুরস্কারে সন্মানিত । তিনি মার্চ ২৩, ১৯৯৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।