রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাংলা সাহিত্য নয় শুধু; বিশ্বসাহিত্যের এক বিচিত্র বিস্ময়। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় এমন সফলভাবে বিচরণ করা শিল্পীর সংখ্যা। সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে খুবই কম। রবীন্দ্রনাথ যে একজন দার্শনিক-কবি, সে প্রমাণ বহন করছে তার শেষ লেখা' কাব্যগ্রন্থ। একজন শিল্পী যে জীবন ও জগতের ব্যাপারে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসবােধে, কত মহীয়ান হয়ে ওঠতে পারেন, সেটির প্রমাণহী হলেন। রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষ লেখা’ কাব্যের ১ সংখ্যক কবিতায় (সম্মুখে শান্তিপারাবার : ১৯৩৯) তিনি জীবনের অন্তিমে মহা শান্তিপারাবার অনুভব করেছেন। স্রষ্টার উদ্দেশ্যে কবি লিখেছেন, স্রষ্টা হলেন মুক্তিদাতা। তাঁর দয়া এবং তার ক্ষমা কবির চিরযাত্রার চিরপাথেয় হবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। জীবনের কর্ণধার স্রষ্টাকে ক্রোড় পেতে কবিকে গ্রহণ করার কথা তিনি বলেছেন। মর্ত্যের বন্ধন যখন ক্ষয় হয়ে যাবে, তখন। বিরাট বিশ্ব যেন কবিকে বাহু মেলে গ্রহণ করে। বিশ্বস্রষ্টার অস্তিত্বময়তার অবিনাশী শাশ্বতবােধ কবির অন্তরে তখন স্পষ্টমান। অসীমের পথে কবি ধ্রুবতারকার জ্যোতিকে জ্বলতে দেখেছেন। মহা অজানার নির্ভয় পরিচয় কবি তার অন্তরে লাভ করেছেন। স্রষ্টা চেতনারূপ অসীম অস্তিত্বের পরিচয়কে কবি ভয়ের মাধ্যমে নয়; নির্ভয়তা, নিশ্চয়তা ও নিশ্চিন্ত অনুভবের মাধ্যমে কবির অন্তরে লাভ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ও অনুভূতি যে কত সুষ্ঠাগত প্রাণ—তারই স্পষ্ট চেতনার আবাহন এই কবিতায় অভিব্যক্ত হয়েছে। ২ সংখ্যক কবিতায় (রাহুর মতন মৃত্যু : ১৯৪০) কবি ‘পরম আমির সত্যে তাঁর অস্তিত্বগত অনুভবকে সম্পর্কিত করেছেন। জীবনের মধ্যে মৃত্যু ছায়া ফেললেও জীবনের স্বর্গীয় অমৃতকে তা গ্রাস করতে পারবে না কখনাে। জীবনে কবির সৃষ্টির যে সম্পদ সে অক্ষয় জ্ঞানৈশ্বর্য তাে স্বর্গীয় অমৃতের মতাে গুরুত্বপূর্ণ। জড়ের কবলে কবির সৃষ্টি কখনাে বিলীন হয়ে যাবে না। মানবের প্রতি এবং স্রষ্টার প্রতি কবির যে প্রেম—সেই প্রেমের মূল্যের অসীমতাকে অস্বীকার করার ও বঞ্চনা করার কোনাে সুযােগ নেই বলে কবি মন্তব্য করেছেন। কবির সৃষ্ট যে সাহিত্যজগৎ—তার প্রতি কবির গভীরতাধর্মী অনুধ্যান এখানে ভাষায়িত হয়েছে। কবি সবচেয়ে সত্য করে বর্তমানে যাকে, যে স্রষ্টা অস্তিত্বকে পেয়েছেন, মিথ্যার মাঝে ছদ্মবেশ ধরে তা এতদিন কবির কাছে ছিলাে। কবি এটিকে কবির অস্তিত্বের কলঙ্ক হিসেবে অভিহিত করেছেন। কবির স্রষ্টাসন্ধানী বােধ যে কত গভীর তাই এখানে ভাষারূপ লাভ করেছে। মৃত্যুকে কবি অস্বীকার করে মৃত্যুঞ্জয়ী চিন্তায় নিজেকে ভাস্বর করে তুলেছেন। বিশ্বের অস্তিত্বসত্তাকে কবি ‘পরম আমি' রূপ স্রষ্টা অস্তিত্বের সত্যের সঙ্গে একাত্ম করে বিবেচনার মাধ্যমে নিশ্চিত মহাসত্যের পথসন্ধানী হয়েছেন এই কবিতায় ।।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।