"তিথিডোর" বইয়ের ভূমিকা থেকে নেয়াঃ এ উপন্যাসে বুদ্ধদেব বসু বাস্তব-জীবনপ্রীতি এবং পরিবার-সংলগ্নতার বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্বমহিমায় তুলে ধরেছেন। তবে জীবনের বহিরাঙ্গ রূপকে তিনি এড়িয়ে যান নি কোনােভাবে। তাই শৈল্পিক দলিলে এটি অনন্য ও অসাধারণ। এ বিষয়ে সরােজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, '...কলকাতার ছা-পােষা মধ্যবিত্ত জীবনের যা কিছু গৌরব, তার যা কিছু সততা- সমস্তের আশ্চর্য পরিবারকেন্দ্রিক চরিত্র তিথিডাের’।... উপন্যাসকে যে স্নিগ্ধ দিনগুলি আর একটু পরেই বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলল, তার শেষ অকৃত্রিম চিহ্ন হিসেবে আমরা মনে রাখব। বিজন এবং বিজনের ব্যবসায়ের গুরু মজুমদার তৎকালীন বাংলাদেশের আসন্ন পতনের পূর্বাভাস।' এ প্রসঙ্গে সন্তোষকুমার ঘােষ বলেন, বৃহৎ উপন্যাসে কখনও কখনও আপনকালের দলিল হয়, তবে বৃহত্ত্ব ছাড়িয়ে মহত্ত্বের মর্যাদা পায়, 'তিথিডাের’ তিরিশের শেষ আর চল্লিশের শুরুর কলকাতার পরিশীলিত একটি সমাজমানসের দলিল। এ উপন্যাসের চরিত্রগুলাের প্রতিটি আপন মহিমা ও বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল। রাজেন বাবু, বিজন, শাশ্বতী, স্বাতী, হরীত, সত্যেন, প্রবীর মজুমদার এরা সবাই যেন একাকীত্বে উপাসক, নৈঃসঙ্গপূজারী, নির্বেদ-নিরানন্দের আরাধনা। এ-কথা দিবালােকের মতাে সত্য যে, এ উপন্যাসের চরিত্রগুলাের গায়ে লেগেছে এই নষ্ট সমাজের ছোঁয়া, সময়ের বিনষ্টিতে বিপন্ন হয়েছে তারা। ফলে তাদের মানসলােকে পরিলক্ষিত হয়েছে নির্বেদ-নৈসঙ্গের সংক্রাম, আকূলিত হয়েছে যেমন ক্ষোভও ফুটে উঠেছে তেমনি। এ উপন্যাসের চরিত্রে কী নেই! সব আছে। উপন্যাসের নায়িকা স্বাতীর চিত্তলােক নৈঃসঙ্গ্যানুভূতিতে বিদীর্ণ ও বিপন্ন। অপরদিকে নায়ক সত্যেনের মাঝে রােমান্টিক নৈঃসঙ্গচেতনার সংক্রাম। তাছাড়া শৈশবে তার চিত্তলােকে উপ্ত হয়েছিল নির্জনতা ও একাকীত্বের বীজ। বাবা-মায়ের অসময়ের মৃত্যু তাকে করেছিল স্বাধীন। কিন্তু স্বাতীর সান্নিধ্যে এসে পেয়ে যায় বিচ্ছিন্নতামুক্তির সঞ্জীবনী মন্ত্র। সব মিলিয়ে এককথায় বলা যায়, এটি একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। এর গাঠনিক বিশালতা অপরিমেয়, অসাধারণ, অনন্য এবং বিস্ময়কর। এ উপন্যাস তাই অতি সহজেই কালকে অতিক্রম করে কালজয়ী হয়েছে- এটা দ্বিধাহীনচিত্তে বলার অপেক্ষা রাখে না।
Buddhadeb Bosu- তিনি নভেম্বর ৩০, ১৯০৮ কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। একজন খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০০৯) এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয়কুমারীর ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ'র কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরি করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরজীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি মার্চ ১৮, ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।