"মফিজন" বইটির ভুমিকা থেকে নেয়াঃ মফিজন মাহবুব-উল আলমের এক সাহসী সৃষ্টি। বিশেষ করে জীবনের নগ্ন বলিষ্ঠতা এই বইটিতে যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে সেকালের পক্ষে তা ছিল এক অভাবনীয় ব্যাপার। বস্তুত চরিত্র মাহবুব-উল আলমের কাছে আইডিয়া মাত্র নয়, যেমন মানুষ নয় নিছক সমাজসত্তার অংশ। কামনা-বাসনা নিয়ে তারা প্রত্যেকেই আলাদা রক্ত-মাংসের মানব ও মানবী। হয়তাে ডি এইচ লরেন্সের মতাে তিনিও মনে করেন, মানুষের ভাবনায় ভুল থাকতে পারে, কিন্তু তার রক্ত যা অনুভব উপলব্ধি ও প্রকাশ করে তাতে ভুল নেই। চরিত্রসৃষ্টি হিসেবেও মফিজন বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়। হতে পারে কিছুটা অস্বাভাবিক, কিন্তু জীবন্ত, অপূর্ব। এক কথায় মফিজন হল সেই ধরনের মেয়ে মৃত্যুর চর্বনের মধ্যে পড়েও গুনে গুনে’ যে। ‘তার দাঁত দেখতে চায়। মফিজন-এর বর্ণনা ও ভাষাভঙ্গিও মনে হয় যেন কেবল এর রচয়িতার পক্ষেই সম্ভব। মফিজন-এর বিরুদ্ধে একদা আপত্তি উঠেছিল যে বইটি অশ্লীল। অগত্যা পত্রিকা বিদ্রুপ করে লিখেছিল : “গল্পে জিনিস আছে। আটাশ পৃষ্ঠার গল্প যে এত বীভৎস, এত horrible হতে পারে মফিজন পড়ার আগে সে জ্ঞান ... ছিল না।” আপত্তির কারণ বইটিতে নারীদেহ এবং জৈবিক আকাঙ্ক্ষা বা মিলনের বর্ণনা খানিকটা খােলামেলা ভাবে এসেছে। তবে এখানে আপত্তিটা বলা বাহুল্য দৃষ্টিভঙ্গিজাত। আমাদের মধ্যযুগের কবি কিংবা ইউরােপের রেনেসাঁস যুগের শিল্পীদের মতােই মফিজন-এর স্রষ্টাও মানবদেহকে পবিত্র ও সুন্দর জ্ঞানে বন্দনা করেছেন। নিজের রচনার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে মাহবুব-উল আলমের মন্তব্য: “পণ্ডিত ও মার্জিত জীবন অপেক্ষা আদিম এবং অমার্জিত জীবন নিয়েই আমার শিল্প গড়ে উঠেছে।” [সঙ্কট কেটে যাচ্ছে] এবং “যে মানুষকে আমি পূজা করি সে মানুষ Elemental, আদিম ও অনাহত।” [আলাপ] মাহবুব-উল আলমকে লেখা পূর্বোক্ত পত্রে অন্নদাশঙ্কর তার লেখার এই elemental' প্রকৃতিরই প্রশংসা করেন। [আলাপ] নিজেকে ‘মােমেন' বা বিশ্বাসী বললেও, কিংবা সম্ভবত সে-কারণেই, অকারণ ধার্মিকতার আড়ম্বরের প্রতি লেখকের মনােভাব সবসময়ই ক্ষমাহীন। তথাকথিত পীর বা ধর্মগুরুদের ভণ্ডামি আমাদের অনেক লেখকেরই বিদ্রুপের বিষয় হয়েছে। তবে মাহবুব-উল আলমের দেখার চোখ ও বলার ভঙ্গি এক্ষেত্রে বিশিষ্টতার দাবি রাখে। মফিজন যার সার্থক পরিচয় বহন করে।
মাহবুব-উল আলম চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ গ্রামে ১লা মে ১৮৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি প্রথম মহাযুদ্ধে যােগ দেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে পল্টন জীবনের স্মৃতি’ লিখেন। লেখায় জীবনের চিত্র ভেসে উঠে বলে তিনি জীবন-শিল্পী হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর সাড়া জাগানাে আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘মােমেনের জবানবন্দী’ ইংরেজী ও উর্দুতে অনুদিত হয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পেশােয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়। তাঁর বহু আলােচিত উপন্যাসিকা মফিজন’ আজও আধুনিক শিল্পকর্ম রূপে সমাদৃত। তাঁর হাস্যরসাত্মক গল্প সংকলন ‘গোঁফ সন্দেশ’ বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযােগ্য সংযােজন। সাহিত্যে মৌলিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যে তিনি সাহিত্যে সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রাইড অব পারফরমেন্স, বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ ও ‘একুশে পদক সহ বহু পুরস্কার লাভ করেন।