"ঘরে - বাইরে" বইয়ের সংক্ষিপ্ত লেখা: বহুমাত্রিক শিল্পস্রষ্টা রবীন্দ্রনাত তাঁর জীবনদর্শ নকে উপন্যাসের বড় আঙ্গিকে বিধৃত করতে চেয়েছিলেন। মানব-মনস্তত্ত্ব, সমাজ-প্রতিবেশ ও প্রকৃতি-পরিবেষ্টনীতে তাঁর উপন্যাসগুলির কাহিনী বিন্যস্ত হয়েছে। তাঁর ঘরে-বাইরে রচনাটি ঔপন্যাসিক সত্তার সর্বেোৎকৃষ্ট প্রকাশরূপ। 1916 সালে লিখিত এই উপন্যাসটি সমকালীন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মূলত তিনটি নর-নারীর জীবনরূপ, মনস্তত্ত্বকে ধা্রণ করেছে। নারী বিষয়ক ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন নানা মত ও চিন্তা প্রকাশ করেছেন। এখানে নায়িকা বিমলাকে নিয়ে স্বামী নিখিলেশের যে পরীক্ষাটি উপস্থাপিত হয়েছে তাতে দুজনের জীবনই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। নারীর মুক্তির প্রশ্নটি বাইরের জগতের প্রেক্ষাপটে যেসব জটিলতার মুখোমুখি হয় তার একটি রূপ আমরা উপন্যাসটিতে পাব। এ ছাড়াা পাওয়া যাবে স্বদেশীদের রাজনীতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ মতাদর্শ । জীবন ও রাজনীতিকে তিনি একত্রে ধারণ করেছেন তিনজনের আত্মকথার আঙ্গিকে। ফলে রচনাটি হয়ে উঠেছে অন্তর্বয়নের কুশলতায় অভিনব। কাহিনীর গতিপরম্পরা, নর-নারীর সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব, প্রেম, চারিত্রিক ত্রুটি-সকল কিছুই এখানে সুবিন্যস্ত। এমনকি রবীন্দ্র-ভাবাদর্শের বিরোধী চরিত্র সন্দীপেরও মনঃছবি আশ্চর্য শৈল্পিক মমতা ও ভাষানৈপুণ্যের গুণে হয়ে উঠেছে সার্বিক জীবনঘন। ঘরে-বাইরে একইসঙ্গে রাজনীতি, নারীমুক্তি-ভাবনা, মানুষের বিচিত্র বেদনা ও আত্মকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বৈশ্যিষ্ট্যে অনন্য। এটি রবীন্দ্রনাথের মানবানুভূতি, এমনকি প্রকৃতি-পরিবেশের মানবায়িত রূপেরও অভিব্যক্তি। ঘরে-বাইরে সমকালীন ঘটনাকেন্দ্রিক হলেও তা চিরকালীন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।